বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়ে বিভিন্ন ক্রমবিবর্তনের একপর্যায়ে বাংলা ভাষা আমাদের আপন করে নিয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতি একটি দেশের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ, গবেষণা, উন্নয়ন তথা উৎকর্ষসাধনে কাজ করে যাচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের 'সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।' একজন ব্যক্তি যে সমাজে জন্মগ্রহণ করে সে সমাজের ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বারা সেই ব্যক্তি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। শিশুর জন্মের পর সবচেয়ে কাছের মানুষ মা। মা কথাটি যেমন মধুর তেমনি মায়ের ভাষাও মধুর। মায়ের ভাষার মূল্য এত বেশি যে, কোনো কোনো জাতির পরিচয় সেই জাতির ভাষা অনুসারে। আমাদের পরিচয় বাঙালি এবং আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। আমাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। যা অন্য সকল জাতি থেকে আমাদের পৃথকভাবে পরিচয় তৈরি করে দিয়েছে।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বল প্রয়োগ ও কূটকৌশলের মাধ্যমে বাংলা বিহার উড়িষ্যা ছাড়াও সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসন শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী সকল আন্দোলনে বাঙালিদের গৌরবময় ভূমিকা ছিলো। ১৯৪৭ সালের ৩ জুনের 'মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা' অনুযায়ী ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই আইন পাশ করে যা 'ভারত স্বাধীনতা আইন' নামে পরিচিত।
'ভারত স্বাধীনতা আইন' অনুযায়ী ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। ১৯৪৭ সালে সুদীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে তৈরি হয় সংকট। ফলে পাকিস্তানের একটি অংশ অন্য অংশের দ্বারা শোষিত হয়। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নিগৃহীত ও শোষিত হতে থাকে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর "দ্বি-জাতি তত্ত্ব বা Two Nation Theory"র ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার মাইলেরও অধিক দূরে ছিলো। শুধু ভৌগোলিক দূরত্বই নয় পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যেও ছিলো ব্যাপক অমিল। ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক কোন মিল ছিলো না। শুধুমাত্র ধর্ম ছাড়া।
দেশ ভাগের সময় 'কংগ্রেস' নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, "পাকিস্তান রাষ্ট্র ২৫ বছরের মধ্যে ভেঙে যাবে।" তার ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হয়েছিলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের মাধ্যমে।
১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হলো তখন নতুন দেশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই প্রশ্নে নির্ধারণ করা হলো উর্দু ভাষাকে যা ছিলো সমগ্র পাকিস্তানের ৩.৩৭% লোকের ভাষা। এমনকি দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগ সরকার অফিস আদালতের পাশাপাশি পোস্টকার্ড, খাম প্রভৃতি জিনিসে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার শুরু করে।
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বলেন,
"পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু,
অপর কোন ভাষা নয়।"
একই বছর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আবারো জোর দিয়ে বলেন,
"উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।"
জনসভা ও সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা শুনে তৎক্ষনাৎ উপস্থিত জনতা না না ধ্বনিতে প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় কর্মী সমাবেশে সকল রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিয়ে "সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কার্যকরী পরিষদ" গঠিত হয়। এ পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ-মিছিল ও সভা হবে। মুসলিম লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা দশ জন করে মিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ এ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানেগ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি চালায়। এতে অনেকে আহত ও নিহত হয়। আন্দোলন আরো তীব্র রুপ নেয়। মাতৃভাষার জন্য সর্বপ্রথম রক্ত দিয়েছে বাঙালিরা।
নৃবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ বোয়াসের মতে, "সমাজের প্রচলিত আচার -অনুষ্ঠান এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি ব্যক্তিবিশেষের যে প্রতিক্রিয়া, এই দুইয়ের সংমিশ্রণে যা সৃষ্টি হয় তাই সংস্কৃতি।" পৃথিবীতে যেসকল প্রাণী আছে সকল প্রাণী থেকে মানুষ পৃথক। কেননা মানুষের আছে বুদ্ধিবৃত্তি। যা অন্য প্রাণীদের নেই। তাই এ কথা বলতে বাধা নেই যে, মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই সংস্কৃতির সন্ধান পেয়েছে বা গড়ে তুলেছে। আর প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্রতা দান করেছে সেই জাতির সংস্কৃতি।
মাতৃভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির একটা গভীর সম্পর্ক আছে। ভাষা সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি হাজার বছরের ঐতিহ্য। আমরা আমাদের জীবন নির্ভর আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করতে গেলে পেয়ে যাই গীতরঙ্গ। যাতে আছে গীত, বাদ্য, নৃত্য, নাট্য, কাহিনী/রুপকথা/কিসসা, পুরাণ ও পুঁথিপাঠ ইত্যাদি। দক্ষিণাঞ্চলের জনপ্রিয় কাহিনি "...সুন্দরবন এলাকায় রামমঙ্গল, বাঁশখালি, আন্ধারমানিক এসব জায়গা দখল করে সারা বনের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে যান বনবিবি।..." অথবা "কমলা রানির সাগর দিঘি।" এসব কাহিনি আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। সুতরাং দেশি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা এবং জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই।
হুমায়ুন আজাদ তার "লাল নীল দীপাবলিবা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী" গ্রন্থের 'বাঙালি বাঙলা বাঙলাদেশ' শিরোনামে লিখেছেন, "বাঙলা সাহিত্য বাঙলাদেশ এবং বর্তমানে যাকে 'পশ্চিম বাঙলা' বলা হয়, তার মিলিত সম্পদ।" তার এই কথার যথার্থ পাওয়া যায় ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে আমাদের ভাষার মিলে এবং একটু লক্ষ করলে আমাদের দৃষ্টিপাত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি..." গানটি। যা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে রবী ঠাকুর রচনা করেছিলেন এই গানটি। কিছুদিন আগে যখন দেশবরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'পদ্মশ্রী'তে ভূষিত হলেন তখন যেন নতুন করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দেশ ছাড়িয়ে দু'টি দেশের যোগসূত্র স্থাপন করলো।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অবদানের কথা বিবেচনা করতে গেলে বলতে হবে ধর্মীয় বন্ধনের কথা। বছরের পর বছর দেশের সংমিশ্রিত সংস্কৃতিতে ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের প্রভাব রয়েছে। সকল ধর্মের মানুষ এক সাথে মিলে মিশে কাজ করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ক্ষণে পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে গঠন হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কেননা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ব্যতীত বাংলার মানুষ আত্মার শান্তি পায় না। আর এই আত্মার শান্তির খোঁজেই যেন ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য হয়েছিলো ভাষা আন্দোলন।
প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কীভাবে বিনষ্টের চেষ্টা করেছিলেন সে পরিচয় পাওয়া যায় তার কর্মে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার সংশোধন করা, যেমন:
“নবনবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান।”
এই লাইন করা হয়েছিলো এরূপ,
“নবনবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব গোরস্থান।”
আবার
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।”
এই জনপ্রিয় লাইনটি সংশোধন করে লিখেন,
“সকালে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি
সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি।”
নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি চলতে থাকে ষড়যন্ত্র। এমনকি রোমান হরফে বাংলা লেখারও উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলা ভাষার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকী পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া, বেতার বা টেলিভিশনে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র সংগীত, নাটক ও নৃত্যনাট্যের সংস্থা বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট গড়ে তোলেন বাঙালিরা।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দুজন প্রবাসী বাংলাদেশির উদ্যোগে। ১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে এই দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে। তারা গড়ে তোলেন “The Mother Language Lover of The World” নামের একটি সংহঠন। তারই ধারাবাহিতায় এসেছে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে বাংলা ভাষার দ্বিতীয় বিশ্বজয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি পায় একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও অভিবাসীরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করেন। যা বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় করিয়ে দেয়। গতবছর ১৪৩০ বর্ষবরণে নিউইয়র্কে মহিতোষ তালুকদার তাপসের নেতৃত্বে শত কণ্ঠে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ইং তারিখে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে ১৪৩১ বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে 'এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড।' প্রথম আলোর সাংবাদিক তোফাজ্জল লিটন ভাইয়ের সুবাদে জানতে পারি, টাইমস স্কয়ার এবং জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় দুদিনের আয়োজনে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করা হবে। ঘোষণার সময় বিশ্বজিত সাহা বলেন, "এবার নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারকে সাজানো হবে রমনার বটমূলের আদলে।"
২০০৩ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় বাংলা সাহিত্যভিত্তিক ওয়েবসাইট 'বাংলাদেশি নভেলস ডট ওআরজি' ওয়েবসাইটটির কার্যক্রম শুরু করেছিলেন বর্তমানে কানাডা-প্রবাসী লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস। ২০২৩ সালে কানাডায় ওয়েবসাইটের বিশ বছর পূর্তি উৎসব করেছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সকল কিচ্ছুই বাংলাদেশি অভিবাসী দ্বারা পালিত হয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসার বিভিন্ন প্রকাশ করেন সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে। এতে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিশেষভাবে পরিচিত হয়।
ইংল্যান্ডের নাগরিক সিস্টার লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট (Lucy Helen Francis Holt) ১৯৬০ সালে মানবিক কাজে অংশ গ্রহণের জন্য তিনি 'বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন চার্চ'-এ যোগ দেন। এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মানুষের সরলতার প্রতি তিনি এতটাই আবিষ্ট হন যে, এরপর আর কখনও তিনি তার নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যাননি।
ছোটবেলায় জাপানী ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর' নাটকটি পড়ে আকৃষ্ট হন জাপানের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কাজুও আজুমা। নাটকের 'অমল' চরিত্র তাকে খুব আকর্ষণ করেছিলো বলে জানা যায়। এরপর তিনি নিজের উদ্যোগেই বাংলা শেখা শুরু করেন। প্রবীর বিকাশ সরকার ২০১৪ সালে ৩ সেপ্টেম্বর "প্রথম আলো" পত্রিকায় লিখেছেন, "১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপানে সফরে গেলে তার দোভাষী ও সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কাজুও আজুমা।" বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি কাজুও আজুমা আগ্রহ দেখে তাকে বাঙালির বন্ধু রুপে অভিহিত করা হয়।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বময়। তবে যখন দেখি আমার সমবয়সী কেউ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এবং বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি নিজেকে বিলিয়ে দেয় তখন বর্তমান প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে মাঝে মাঝে নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হই। অপসংস্কৃতির আড়ালে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হুমকির মুখে। বর্তমান সময়ে ভাষার বিকৃতি নিয়ে একটা চরম প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত চিন্তক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলা ভাষার বিকৃতিকে ‘বাংলিশ’ হিসেবে অবিহিত করেছেন। ভাষার এই বিকৃতি ‘রোমান হরফে বাংলা’ লেখার অপচেষ্টার কথা মনে করিয়ে দেয়। ইউনিভারসিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, “দেশের সম্পদশালী উচ্চবৃত্তের মানুষগুলো বাংলা ভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।” আমি আমার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নতুন একটি ভাষা শিখতে পারি তার মানে এই নয় যে আমার নিজের শিকড় ভুলে যাব। ঢাকা উদ্যান সরকারি মহাবিদ্যালয়ে যখন পড়াশোনা করি তখন এক অনলাইন ক্লাসে বাংলা বিভাগের শিক্ষক শারমিন তামান্না নূপুর ম্যাডাম বলেছিলেন, "গাছের শিকড় যত গভীরে যায় গাছ তত মজবুত হয়।" তাই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যত বেশি গুরুত্ব দিতে পারবো ততই আমাদের জন্য কল্যাণ হবে একথা বলতে দ্বিধা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ'- এরূপ কথাই বলেছেন, "... নিজের দেশকে ভালো করিয়া জানিবার অভ্যাস হইলে অন্য সমস্ত জানিবার যথার্থ ভিত্তিপত্তন হইতে পারিবে।"
'আত্মানং বিদ্ধি' অর্থাৎ নিজেকে জানো।
আমরা আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানিনা। কিন্তু পশ্চিমা সম্পর্কে জানি। আমাদের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব তুচ্ছ। ভারতবর্ষ থেকে ১৯৪৭ সালে উপনিবেশবাদ শেষ হলেও সাহেবদের সংস্কৃতি এখনও রয়ে গেছে। ফলে ভারতীয়রা দেখতে ভারতীয় হলেও চিন্তা ভাবনা ব্রিটিশ কেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন, "নিজ দেশ আমাদের কাছে অস্পষ্ট এবং পরের দেশের জিনিস আমাদের কাছে অধিকতর পরিচিত হইয়া আসিয়াছে। এজন্য যদিও আমরা স্বদেশে বাস করিতেছি, তথাপি স্বদেশ আমাদের জ্ঞানের কাছে সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র হইয়া আছে।" তাই আমাদের উচিত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ, গবেষণা, উন্নয়ন তথা উৎকর্ষসাধনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আশা। তাহলেই বিশ্বব্যাপী আরো বেশি সমৃদ্ধ হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি।
লেখক: মুহাম্মদ আল ইমরান, নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments
Post a Comment