Skip to main content

কৃষি দেবতা শিবকে কেন্দ্র করে নাট্যের উদ্ভব।

কৃষি দেবতা শিবকে বলা হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ দেবতা। কৃষি দেবতা শিবকে কেন্দ্র করে নাট্যের উদ্ভব। আতি প্রাচীন কাল থেকেই আর্যদের মধ্যে নাটকের চর্চা প্রচলিত ছিল। "শিবের নিকট থেকেই আর্যগণের দেবতা ব্রহ্মা নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন।" (পৃ. ১৪৫, বিশ্বরঙ্গালয় ও নাটক- গীতা সেনগুপ্ত)


থিয়েটারের কথা বইতে নিয়া হায়দার বলেছেন, "ভারতবর্ষে থিয়েটারের উৎপত্তির পিছনে লৈৗকিক ধর্ম-চেতনা ও বিশ্বাসই কার্যকর ছিল।" প্রাচীন সমাজে, পৃথিবীর সর্বত্রই, আচার-অনুষ্ঠানে নৃত্য ও গীত, নাট্যশিল্পের প্রাথমিক উপাদান বিধ্যমান ছিল। শিবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আয়োজন করা হত। শিবের কর্মকান্ড নাট্য আকারে প্রকাশ বা প্রদর্শন করা হত। কিন্তু ব্রিটিশরা প্রচার করে উপমহাদেশে তারাই প্রথম নাটকের উদ্ভব করে। আমাদের ঐতিহ্য অনুধাবন করে বলা যায় যে ব্রিটিশদের ভাষ্য ভ্রান্ত। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগেই আমাদের নাট্য ছিলো। প্রাচীন কাল থেকেই পূজায় নাট্য রূপ পেতে থাকে। যেমন: চড়ক পূজা, লালকাচ নৃত্য, নীলপূজা, পাটস্মান ইত্যাদি।


চড়ক পূজার মাধ্যমে কৃষিপতি শিবকে স্মরণ করা হত। একজন কে দড়িতে বেধে চরকির মত ঘুড়ানো হত। তার হাতে ত্রিশূলে ফল বা খাবার থাকতো। উপর থেকে ঐ ফল লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হত। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে লোকজন শিবকে ধারণ করতো। অর্থাৎ এই চড়ক পূজার মধ্যেও কিন্তু নাট্যের বিকাশ রয়েছে।

2

শত শত বছরের পুরানো কাচনৃত্য লালকাঁচ বা ঢোলকাচ নামে পরিচিত। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন এই লালকাঁচ নৃত্য করা হয়।


পাটস্মান উৎসবের মাধ্যমে দেবতা ও অশুভ আত্মদের- সংঘর্ষ এবং দেবতাদের বিজয় নাট্য রুপে প্রদর্শন করা হয়। যেখানে তাদের আত্মার রূপ, দেবতাদের রূপ ইত্যাদি নিতে হয়। সেখানেও নাট্যর উপাদান বিধ্যমান।


অন্যদিকে নীল পূজা বা নীলষষ্ঠী হলো সনাতন বঙ্গীয়দের এক লোকোৎসব যা মূলত নীল-নীলাবতী নামে শিব- দুর্গার বিবাহ উৎসব। এই উৎসবের যথার্থতা পাওয়া যায় সেলিম আল দীন রচিত মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য বইতে। সেখানে উল্লেখিত আছে, বরিশালে প্রাপ্ত একটি ছোট পালায় পাওয়া যায় শিব বা সূর্যাই এর সাথে গৌরীর বিবাহ এবং গৌরীর সঙ্গে আপন গৃহে যাত্রার কাহিনী।


"প্রাচীন ভারতবর্ষে মানুষের সৃষ্টিসর্বপ্রকার জীবন ও শিল্পকর্ম ধীরার পিছনে দেবতাদের হাত ও আশীবাদ রয়েছে, অথবা দেবতারাই সৃষ্টি করে দিয়েছেন, এরুপ মনোভাব সর্বক্ষেত্রেই কার্যকর ছিল।" (পৃ: ৭৮, থিয়েটারের কথা ১ম খন্ড- জিয়া হায়দার) পৌরাণিক কাহিনী নাট্য সৃষ্টিতে ব্রহ্মাকে নাট্যের স্রষ্টা বলা নেকে মূলত ব্রহ্মা শিবের কাছ থেকে নাট্য শিক্ষা করে তা ভরতকে দান করেছেন। "নাট্যবেত্তারা মনে কারেন এথেন্সে থিয়েটার শিল্পরূপে প্রকাশের দুই হাজার বছর আগে থেকে ভারতবর্ষে একাধিক নৃত্যানুষ্ঠানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটো।" (পৃঃ ৭১, থিয়েটারের কথা- জিয়া হায়দার)

ভরতের কাহিনীতে শিবের নৃত্যশিক্ষা দানের কথা পাওয়া যায়। আর নৃত্য থেকেই নাট্য কথাটি এসেছে। আমরা জানি নাট্যে থিয়েটারের সকল উপাদান (যেমন: চরিত্র, ঘটনা, মেকাপ, পোশাক, স্থান, সংলাপ, গীতনাট্য, বাদ্য ইত্যাদি) পরিপূর্ণরূপে থাকে। অন্যদিকে নাট্যের সকল উপাদান না থাকলেও উপাদানের নিমিত্তে নাট্য মূল।

কৃষি দেবতা শিবের কার্যক্রমে নাটকের উপাদানের প্রয়োজন হয়। শিবের রুপ ধারণে মেকাপ, স্থান, চরিত্র ইত্যাদি পাওয়া যায়। অর্থাৎ নাট্যমূল বা নাট্যের উদ্ভবে কৃষি দেবতা শিবের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।


আর্যদের বেদের সংখ্যা চারটি ঋকবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অর্থবেদ। আর্যদের চতুর্বেদ পাঠ করার সুযোগ ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের। কালক্রমে বৈশ্য ও শূদ্রদের মধ্যে থেকে দাবি আসে পড়ার অধিকারের। পরে দেবতারা ব্রহ্মাকে পঞ্চমবেদ তৈরির কথা বলেন। এরই পরিপেক্ষিতে তৈরি হয় নট্যবেদ। ব্রহ্মা ঋকবেদ থেকে কথা, যজুর্বেদ থেকে ক্রিয়া বা অভিনয়, সামবেদ থেকে গীত এবং অর্থবেদ থেকে রস নিয়ে নাট্যবেথ সৃষ্টিকরেন। যা পঞ্চম বেদ বা গন্ধর্ববেদ হিসেবে পরিচিত।  পঞ্চমবেদ রচনা করে ব্রহ্মা বলেন, "এতে নৃত্য, গীত, বাদ্য, কাব্য প্রভৃতি সকল শিল্পের সমন্বয় ঘটবে।" নাট্যবেদ থেকে পূর্বে যেখানে নাট্যের উদ্ভব সেখানে আছে কৃষিদেবতা শিব।


লেখক: মুহাম্মদ আল ইমরান।

(নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।)

Comments