১. কবিতা: রঙরেজিনী।
লেখক: রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর।
শঙ্করলাল
দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত।
শাণিত তাঁর বুদ্ধি
শ্যেনপাখির চঞ্চুর মতো,
বিপক্ষের যুক্তির উপর পড়ে বিদ্যুদ্বেগে--
তার পক্ষ দেয় ছিন্ন করে,
ফেলে তাকে ধুলোয়।
রাজবাড়িতে
নৈয়ায়িক এসেছে দ্রাবিড় থেকে।
বিচারে যার জয় হবে সে
পাবে রাজার জয়পত্রী।
আহ্বান স্বীকার করেছেন শঙ্কর,
এমন
সময় চোখে পড়ল পাগড়ি তাঁর মলিন।
গেলেন রঙরেজির ঘরে।
কুসুমফুলের
খেত, মেহেদিবেড়ায় ঘেরা।
প্রান্তে থাকে জসীম রঙরেজি।
মেয়ে
তার আমিনা, বয়স তার সতেরো।
সে গান গায়
আর রঙ বাঁটে,
রঙের সঙ্গে রঙ মেলায়।
বেণীতে
তার লাল সুতোর ঝালর,
চোলি তার বাদামি রঙের,
শাড়ি তার আশমানি।
বাপ
কাপড় রাঙায়,
রঙের বাটি জুগিয়ে দেয় আমিনা।
শঙ্কর
বললেন, জসীম,
পাগড়ি রাঙিয়ে দাও জাফরানি রঙে,
রাজসভায় ডাক পড়েছে।
কুল্
কুল্ করে জল আসে নালা
বেয়ে কুসুমফুলের খেতে;
আমিনা
পাগড়ি ধুতে গেল নালার ধারে তুঁত গাছের ছায়ায় বসে।
ফাগুনের
রৌদ্র ঝলক দেয় জলে,
ঘুঘু ডাকে দূরের আমবাগানে।
ধোওয়ার কাজ হল, প্রহর গেল কেটে।
পাগড়ি
যখন বিছিয়ে দিল ঘাসের 'পরে
রঙরেজিনী দেখল তারি কোণে
লেখা আছে একটি শ্লোকের একটি চরণ--
"তোমার শ্রীপদ মোর ললাটে বিরাজে'।
বসে বসে ভাবল অনেক ক্ষণ,
ঘুঘু ডাকতে লাগল আমের ডালে।
রঙিন
সুতো ঘরের থেকে এনে
আরেক
চরণ লিখে দিল--
"পরশ পাই নে তাই হৃদয়ের
মাঝে'।
দুদিন গেল কেটে।
শঙ্কর এল রঙরেজির ঘরে।
শুধালো,
পাগড়িতে কার হাতের লেখা?
জসীমের ভয় লাগল মনে।
সেলাম করে বললে, "পণ্ডিতজি,
অবুঝ আমার মেয়ে,
মাপ
করো ছেলেমানুষি।
চলে যাও রাজসভায়--
সেখানে
এ লেখা কেউ দেখবে না, কেউ বুঝবে না।'
শঙ্কর আমিনার দিকে চেয়ে বললে,
"রঙরেজিনী,
অহংকারের-পাকে-ঘেরা ললাট থেকে নামিয়ে এনেছ
শ্রীচরণের স্পর্শখানি হৃদয়তলে
তোমার হাতের রাঙা রেখার পথে।
রাজবাড়ির পথ আমার হারিয়ে
গেল,
আর পাব না
খুঁজে।'
২. কবিতা: মুক্তি।
লেখক: রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর।
বাজিরাও পেশোয়ার অভিষেক হবে
কাল সকালে।
কীর্তনী এসেছে গ্রামের থেকে,
মন্দিরে ছিল না তার স্থান।
সে বসেছে অঙ্গনের এক কোণে
পিপুল গাছের তলায়।
একতারা বাজায় আর কেবল সে ফিরে ফিরে বলে,
"ঠাকুর, তোমায় কে বসালো
কঠিন সোনার সিংহাসনে।'
রাত তখন দুই প্রহর,
শুক্লপক্ষের চাঁদ গেছে অস্তে।
দূরে রাজবাড়ির তোরণে
বাজছে শাঁখ শিঙে জগঝম্প,
জ্বলছে প্রদীপের মালা।
কীর্তনী গাইছে,
"তমালকুঞ্জে বনের পথে
শ্যামল ঘাসের কান্না এলেম শুনে,
ধুলোয় তারা ছিল যে কান পেতে,
পায়ের চিহ্ন বুকে পড়বে আঁকা
এই ছিল প্রত্যাশা।'
আরতি হয়ে গেছে সারা--
মন্দিরের দ্বার তখন বন্ধ,
ভিড়ের লোক গেছে রাজবাড়িতে।
কীর্তনী আপন মনে গাইছে--
"প্রাণের ঠাকুর,
এরা কি পাথর গেঁথে তোমায় রাখবে বেঁধে।
তুমি যে স্বর্গ ছেড়ে নামলে ধুলোয়
তোমার পরশ আমার পরশ
মিলবে ব'লে।'
সেই পিপুল-তলার অন্ধকারে
একা একা গাইছিল কীর্তনী,
আর শুনছিল আরেকজনা গোপনে--
বাজিরাও পেশোয়া।
শুনুছিল সে--
"তুমি আমায় ডাক দিয়েছ আগল-দেওয়া ঘরের থেকে,
আমায় নিয়ে পথের পথিক হবে।
ঘুচবে তোমার নির্বাসনের ব্যথা,
ছাড়া পাবে হৃদয়-মাঝে।
থাক্ গে ওরা পাথরখানা নিয়ে
পাথরের বন্দীশালায়
অহংকারের-কাঁটার-বেড়া-ঘেরা।'
রাত্রি প্রভাত হল।
শুকতারা অরুণ-আলোয় উদাসী।
তোরণদ্বারে বাজল বাঁশি বিভাসে ললিতে।
অভিষেকের স্নান হবে,
পুরোহিত এল তীর্থবারি নিয়ে।
রাজবাড়ির ঠাকুরঘর শূন্য।
জ্বলছে দীপশিখা,
পূজার উপচার পড়ে আছে--
বাজিরাও পেশোয়া গেছে চলে
পথের পথিক হয়ে।
৩. কবিতা: সাধারণ মেয়ে।
লেখক: রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর।
আমি
অন্তঃপুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তোমার
শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,
"বাসি ফুলের মালা'।
তোমার
নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ
বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,
দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে--
জিতিয়ে দিলে তাকে।
নিজের কথা বলি।
বয়স
আমার অল্প।
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের
মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে--
ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।
আমার
মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।
তোমাকে দোহাই দিই,
একটি
সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
বড়ো দুঃখ তার।
তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ
যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচা
বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না
সত্যের খোঁজে,
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।
কথাটা কেন উঠল তা বলি।
মনে করো তার নাম নরেশ।
সে
বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।
এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয়
না,
না করব যে
এমন জোর কই।
একদিন সে গেল বিলেতে।
চিঠিপত্র পাই কখনো বা।
মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে
সে দেশে,
এত তাদের ঠেলাঠেলি
ভিড়!
আর তারা কি
সবাই অসামান্য--
এত বুদ্ধি, এত
উজ্জ্বলতা।
আর তারা সবাই
কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে
স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।
গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে
লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে--
বাঙালি কবির কবিতা ক' লাইন দিয়েছে
তুলে
সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে--
তার পরে বালির 'পরে বসল পাশাপাশি--
সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।
লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
"এই সেদিন তুমি
এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;
ঝিনুকের দুটি খোলা,
মাঝখানটুকু ভরা থাক্
একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে--
দুর্লভ, মূল্যহীন।'
কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।
সেইসঙ্গে
নরেশ লিখেছে,
"কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,
কিন্তু চমৎকার--
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও
কি সত্য নয়।'
বুঝতেই পারছ
একটা
তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য
কাঁটার মতো
আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়--
আমি
অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই
এমন ধন নেই আমার
হাতে।
ওগো, নাহয় তাই হল,
নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।
পায়ে
পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প--
যে
দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে--
অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে
নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
হার হয়েছে আমার।
কিন্তু
তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।
তাকে নাম দিয়ো মালতী।
ওই নামটা আমার।
ধরা পড়বার ভয় নেই।
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে।
তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।
কী করে জিতিয়ে
দেবে।
উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,
দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।
দয়া কোরো আমাকে।
নেমে এসো আমার সমতলে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার
কাছে যে অসম্ভব বর
মাগি--
সে বর আমি
পাব না,
কিন্তু
পায় যেন তোমার নায়িকা।
রাখো-না কেন নরেশকে
সাত বছর লণ্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক্ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।
ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম| এ|
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
কিন্তু ওইখানেই যদি থাম
তোমার
সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
আমার দশা যাই হোক
খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।
তুমি তো কৃপণ নও
বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে
দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক
ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদের
মতো আবিষ্কার করুক ওকে--
শুধু বিদুষী ব'লে নয়,
নারী ব'লে।
ওর
মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু
আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়--
যে দেশে আছে
সমজদার, আছে দরদি,
আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি।
মালতীর
সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না,
বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে
করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান
দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়--
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।
ওর চোখ দেখে
ওরা করছে কানাকানি,
সবাই
বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে
জনান্তিকে বলে রাখি
সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
বলতে হল নিজের মুখেই,
এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।)
নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
আর তার সেই
অসামান্য মেয়ের দল।
আর তার পরে?
তার
পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,
স্বপ্ন আমার ফুরোল।
হায় রে সামান্য মেয়ে!
হায় রে বিধাতার শক্তির
অপব্যয়!
৪. কবিতা: ক্যামেরিয়া।
লেখক: রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর।
নাম
তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে
চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি
ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল
রেখাটি দেখা যায়,
আর
ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।
এখন
থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই--
সে হিসাব আমার
কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ
না থাক্,
ও তো আমার
সহযাত্রিণী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝক্ঝক্ করছে যেন।
সুকুমার
কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে
ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি--
রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত,
কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।
এমন তো আজকাল ঘটেই
থাকে।
কিন্তু
আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে--
না
সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের।
একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়।
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে
করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে।
এমন
সময়ে সে এক মোটা
চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললুম, "ফেলো চুরোট।'
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ ক'রে--
আর
কিছু বললে না, এক লাফে নেমে
গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,
বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা
নিচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের
বাবুরা বললে, "বেশ করেছেন মশায়।'
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।
পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম,
ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের
দায় নিজেই পারে নিতে,
আমাকে কোনো দরকারই ছিল না।
আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা--
বীরত্বের
স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে।
খবর
পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া--
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে
গাছের
আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব
মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে
দেখা,
মোহনলাল--
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, "তনুকা
আমার বোন,
কিছুতে
ছাড়বে না তোমার সঙ্গে
দেখা না করে।'
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয়
ততটুকু--
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের 'পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি--
মনে
করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ
দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!
যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে
তনুকা বললে,
"একটি
জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা--
একটি ফুলের গাছ।'
এ
এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, "দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে
অনেক যত্নে বাঁচে।'
জিগেস করলেম, "নামটা কী?'
সে বললে "ক্যামেলিয়া'।
চমক লাগল--
আর-একটা নাম
ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, "ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে
না।'
তনুকা
কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,
খুশিও হল।
চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা
গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ
দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।
পুজোর
ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগনায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে--
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর
জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন
শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।
সেখানে
নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে
তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়--
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি
কোথাও নেই,
তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।
কমলা
এসেছে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে
দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ও পারে,
সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর
আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে
লক্ষ্য করে না বলেই।
একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।
ইচ্ছে
হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে
নদী থেকে--
পারি
বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি
জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।
দেখলেম
দলের মধ্যে একজন যুবক--
শট্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরোট খাচ্ছে।
আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।
মুহূর্তে
বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার
নির্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি
চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই
ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি
এগোল কত দূর।
সময়
হয়েছে আজ।
যে আনে আমার
রান্নার কাঠ।
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে
থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, "বাবু, ডেকেছিস কেনে।'
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল
মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে
আবার জিগেস করলে, "ডেকেছিস কেনে।'
আমি বললেম, "এইজন্যেই।'
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
৫. কবিতা: বনলতা সেন।
লেখক: জীবনানন্দ
দাশ।
হাজার
বছর ধ’ রে আমি
পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল
সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক
ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে
ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি
ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে
দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল
তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ
তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল
ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে
দিশা
সবুজ
ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে
দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি
দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির
নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত
দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা
আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর
সব রং নিভে গেলে
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন
গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব
পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায়
এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে
শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
৬. কবিতা: অদ্ভুত আঁধার এক।
লেখক: জীবনানন্দ
দাশ।
অদ্ভুত
আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা
অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে
তারা;
যাদের
হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী
অচল আজ তাদের সুপরামর্শ
ছাড়া।
যাদের
গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো
যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে
হয়
মহত্
সত্য বা রীতি, কিংবা
শিল্প অথবা সাধনা
শকুন
ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
লেথক: সুকুমার
রায়।
ঠাস্ ঠাস্
দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খট্কা
ফুল ফোটে
? তাই বল ! আমি ভাবি পট্কা !
শাঁই শাঁই
পন্পন্, ভয়ে কান বন্ধ—
ওই বুঝি ছুটে
যায় সে–ফুলের গন্ধ ?
হুড়মুড় ধুপ্ধাপ্
– ওকি শুনি ভাই রে !
দেখ্ছ না
হিম পড়ে–যেওনাকো বাইরে ৷
চুপ চুপ ঐ
শোন্ ! ঝুপ্ ঝাপ্ ঝ—পাস !
চাঁদ বুঝি
ডুবে গেল ?—গব্ গব্ গ—বাস !
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশ্
ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্, রাত কাটে ঐরে !
দুড়্ দাড়্
চুরমার–ঘুম ভাঙে কই রে !
ঘর্ ঘর্ ভন্
ভন্ ঘোরে কত চিন্তা !
কত মন নাচে
শোন্—ধেই ধেই ধিন্তা !
ঠুং ঠাং ঢং
ঢং, কত ব্যথা বাজে রে—
ফট্ ফট্ বুক
ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে !
হৈ হৈ মার্
মার্ 'বাপ্ বাপ্' চীৎকার—
মালকোঁচা
মারে বুঝি ? সরে পড়্ এইবার ৷
কবি : মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
হে
বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা
সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত,
করিনু ভ্রমণ
পরদেশে,
ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু
বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়,
নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু
বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; -
কেলিনু
শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে
তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে -
"ওরে
বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ
ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা
ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি
ঘরে!"
পালিলাম
আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।
কৃতজ্ঞতা-
কামালউদ্দিন
কবির স্যার
সহকারী
অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সংগ্রহ-
মুহাম্মদ
আল ইমরান
শিক্ষার্থী,
নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
Comments
Post a Comment