শিরোনাম: বাংলা নাট্য ও নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (১৭৯৫-১৯৪৭)।
কোর্সের নাম: বাংলা নাট্যের ইতিহাস (১৭৯৫-১৯৪৭)।
কোর্স কোড: নাট্য ১২০১
কোর্স শিক্ষক: মো. এনামুল হাসান কাওছার স্যার।
(খণ্ডকালীন শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,
ঢাকা। সহ-ব্যবস্থাপক - জনসংযোগ ও যোগাযোগ বিভাগ, সেমস-গ্লোবাল ইউএসএ।)
লেখক: মুহাম্মদ আল ইমরান। (শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।)
তারিখ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
সূচিপত্র
ক্রমিক |
শিরোনাম |
পৃষ্ঠা |
১ |
ভূমিকা |
৩ |
২ |
বিদেশী রঙ্গালয় |
৪ |
৩ |
লেবেদেফ ও বেঙ্গলী থিয়েটার |
১২ |
৪ |
সখের নাট্যশালা |
১৫ |
৫ |
পেশাদারি থিয়েটার |
২৫ |
৬ |
ঢাকার নাট্যচর্চা |
৩৩ |
৭ |
অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬ |
৩৭ |
৮ |
গণনাট্য আন্দোলন |
৩৯ |
৯ |
তথ্যসূত্র ও টীকা |
৪১ |
সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত নাটকও একটি তাৎপর্যপূর্ণ শাখা। নাট্য ও নাটকের মধ্যে রয়েছে বিশেষ পার্থক্য। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে এই পার্থক্য লক্ষণীয় নয়। কোন সংলাপ বা বর্ণনা নির্ভর রচনা অর্থাৎ পান্ডুলিপিকে বলা হয় নাটক। অন্যদিকে পাণ্ডুলিপি যখন মঞ্চে অভিনীত হয় বা মঞ্চস্থ হয় তাকে নাট্য বলে। নাট্য, নাটক, নট, নটী এই সকল শব্দের মূলে রয়েছে নট্। নট্ মানে নড়াচড়া করা। আর নাট্যের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Drama. যা গ্রিক Dracin থেকে এসেছে। এর অর্থ To Do কিংবা কোন কিছু করা। বাংলা নাটকের শুরু থেকে নাট্য ও নাটকের একটি সুগম পথ তৈরি হয়েছে। অবশ্য এই পথে রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের অস্তিত্ব কিংবা বিদেশিদের প্রভাব। একদিকে যেমন নাটক প্রকাশিত হয়েছে অন্যদিকে মঞ্চস্থ হয়েছে। তবে এই নাট্য ও নাটকের ইতিহাস তৈরি হতে ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব লক্ষণীয়।
সেলিম আল দীন তার চাকা নাটকের মুখবন্ধে লিখেছেন, "রাজনৈতিক অভিপ্রায় নাটকের শরীরে নেই- শিরায়
হয়ত আছে।”১ যেমন বাংলা নাটকে রানৈতিক
আলাপ আছে তেমেই বাংলা নাট্য ইতিহাসে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তাই নাট্য ও নাটকের প্রসঙ্গ সন্ধানের অগ্রে বাংলার রাজনৈতিক পালাক্রমের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। বাংলার ইতিহাস বলতে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার বিগত সহস্রাব্দের ইতিহাসকে বোঝায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশীর প্রান্তে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়। ফলে পথ সূচিত হয় ব্রিটিশ শাসনের। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্রিটিশ রাজ বা রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে হস্তান্তর করে তখন থেকে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্গত হয় ভারতীয় উপমহাদেশ। যা ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে এসে তাদের অবসর বিনোদনের জন্য তৈরি করেন- ওল্ড প্লে হাউজ(প্রতিষ্ঠা: ১৭০০ পরবর্তী সময়ে), দি নিউ ওল্ড প্লে হাউজ বা ক্যালকাটা থিয়েটার(প্রতিষ্ঠা: ১৭৭৫) সহ আরো অসংখ্য নাট্যশালা। ১৭৯৫ সালে রাশিয়ান ভদ্রলোক গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় ২৫ নম্বর ডোমতলার(এজরা স্ট্রিট) একটি বাড়িতে "দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার" নামে থিয়েটার গড়ে তোলেন। যেখানে দ্য ডিজগুয়িজ(The disguise) এর অনুবাদ 'কাল্পনিক সংবদল' মঞ্চস্থ করেন ১৭৯৫ সালের ২৭ শে নভেম্বর। আগত বহিরাগতদের নির্মিত নাট্যমঞ্চের আগে বাংলায় নাটক অভিনীত হত মুক্তমঞ্চে যা নাটমন্দির নামে পরিচিত। "প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষে নাট্যচর্চা প্রচলিত ছিল। আর্যদের যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানে নাটকীয়তা ছিল। বৌদ্ধযুগেও প্রচারধর্মী নাটক লেখা হয়েছিল। ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে নাটকের রীতি ও নাট্যমঞ্চের ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমদিকে নাট্যানুষ্ঠান হত বাগানের মধ্যে, রাজপ্রাসাদের বা কোন মন্দিরে পরে অভিনয়ের জন্য নাট্যমন্দির তৈরি হয়।"২ তবে বাংলা নাটকের শুরুতে অনেক বড় একটা স্থান দখল করে আছে যাত্রা। যাত্রা শব্দের সঙ্গে বাঙালিয়ানা রয়েছে। গ্রামের কোন উৎসব আয়োজনে খোলা আসরে বহু মানুষের সমাগমে যাত্রা অভিনীত হত।
বাংলা নাট্য ও নাটকের ইতিহাস আলোকপাত করতে গেলে প্রসঙ্গত নাট্যমঞ্চ নিয়ে আলোচনা চলে আসবে। “উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই এদেশে রঙ্গালয় ও নাটক পারস্পরিক সম্পর্কায়িত হয়েই এগিয়ে চলেছে। লেবেডেফকে সমকালীন 'মঞ্চব্যবস্থা' এবং বিশেষ করে অভিনেতা-অভিনেত্রী ও দর্শকদের কথা বিচার করেই নাট্যরূপ অভিনয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।“৩ নিম্নে পর্যায়ক্রমে বাংলা বাংলা নাট্য ও নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হলো।
বিদেশী রঙ্গালয়
ওল্ড প্লে-হাউস (Old Play-House):
কলকাতার লালবাজার স্ট্রিটের দক্ষিন-পশ্চিম কোণে সেন্ট এন্ড্রুজ গির্জার উল্লোদিকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে "ওল সে হাউস" নামক নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা। নির্দিষ্ট ভাবে বলা না গেলেও অনুমান বায়া মায় ১৬৯০- ১৭৫৩ আলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেননা ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বানিজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে পদার্পন করে। কলকাতায় জাঁকিয়ে বসার পর ইংরেজরা নিজেদের বিনোদনের প্রয়োজনে নাট্যশালা তৈরি করেন। আর ”মিস্টার উইলের আঁকা ১৭৫৩ সালের কলকাতার মানচিত্রে- “ওল্ড প্লে-হাউস" ও সংলগ্ন নাচঘরের পরিচয় পাওয়া যায়।”৪ অর্থাৎ ১৬৯০ থেকে ১৭৫৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে' ওল্ড প্লে হাউস তৈরি হয়।
চিত্র
১: ওল্ড প্লে হাউস।
ঘটনাক্রমে, কলকাতা তখন ইংরেজদের ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছিল। লাল সংকেত দেখছিলেন নবাব সিরাজদৌল্লা। সেজন্য নবাব ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতায় আক্রমণ করেন। কলকাতার নাম পরিবর্তন করে তার নানার নামে "আলিনগর" রাখেন। নবাববাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় ইংরেজদের তৈরি ”ওল্ড প্লে-হাউস” নামক নাট্যশালা ১৭৫৬ সালের জুন মাসে। ’ওল্ড প্লে-হাউস’ নাট্যশালার অভিনয়ের কোন সংবাদ পাওয়া যায় নি। কারণ সে সময়ে কোন সংবাদপত্র ছিল না।
নবাব সিরাজদৌল্লা'র কলকাতা আক্রমনের এক বছরের মাথায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ হয়। ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষের শাসনকর্তা হতে শুরু করে বদলে যায় ভারতবর্ষের ইতিহাস। ১৭৫৬ সালের পর ভগ্নদশাপ্রাপ্ত ওল্ড প্লে-হাউস শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় নিলামঘর ও ব্যবসায়ীদের মালপত্র- রাখার গুদাম। ওল্ড প্লে হাউস বন্ধ হওয়ার পর ১৯ বছর কলকাতায় কোন নাট্যশালা ছিল না ইংরেজদের।
দি নিউ প্লে হাউস
(The New Play House) বা
ক্যালকাটা থিয়েটার:
অধুনা কলকাতার মহাবকরণ বা রাইটার্স বিল্ডিং এর পেছনে লায়ন্স রেঞ্জের উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল 'ক্যালকাটা থিয়েটার'। এটি ছিল ১ম থিয়েটার ধ্বংসের ১৯ বছর পর প্রতিষ্ঠিত ইংরেজদের ২য় নাট্যশালা।
১৭৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউ বে প্লে হাউস ১৮০৪ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। বালাট হেস্টিংসের আমলে এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন জর্জ উইলিয়াঙ্গল দি নিউ পেহডিস এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বড়লাট হেস্টিংস ও ইলাইজা ইম্পে। প্রায় এক লক্ষ টাকা ব্যয় হয় নাট্যশালা নির্মানে।
নাট্যশালার দৃশ্যপট নির্মাণের জন্য ডেবিড গ্যানিফের সহায়তায় শিল্পী বার্নাড মেসিংককে কলকাতায় আনা হয়। ক্যালকাটা থিয়েটারে প্রথম দিকে ভারতীয় দর্শকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কলকাতায় প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি সংবাদপত্র 'হিকিজ বেঙ্গলি (গজেট’ সংখ্যায় (১৭৮০) প্রথম পৃষ্ঠায় বাঁদিকে ক্যালকাটা থিয়েটারের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
নাট্যশালার মাঝ খানে ছিল 'পিট' এবং এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত' পিট'কে ঘিরে 'বক্স।' বক্সের জন্য এক মোহর এবং পিট সিটের জন্য আট সিক্কা টাকা ছিল টিকিটের দাম।
ক্যালকাটা থিয়েটারে সর্বপ্রধম
Subscription Performance
প্রথা চালু হয়। বস্তুত স্বল্পসংখ্যক ইংরেজ দর্শনের কারণে টিকিট বিক্রি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পূর্বে থেকে টিকিট বুকিং দেয়া হত। ১২০ টাকার টিকিটে একজন ইংরেজ পুরুষ ও তাঁর বাড়ির মহিলারা মোট ছয়টি অভিনয় দেখার সুযোগ পেতেন।
লর্ড কর্ণওয়ালিসের নির্দেশে নিউ প্লে হাউস এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোমপানির কোন কর্মচারী অভিনয়ে অংশগ্রহণের অনুমতি পেতেন না। ফলে অভিনেতারা সকলেই ছিলের অপেশাদার বা অ্যামেচার। প্রথম দিকে নারী চরিত্রে পুরুষরা অভিনয় করতো। অবশ্য কোম্পানির আইন শিথিল হওয়ার পর মহিলারা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে।
ক্যালকাটা থিয়েটার এর উদ্যোক্তারা সমস্ত শ্রেণীর দর্শকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতেন। তাই শেক্সপীয়র থেকে শুরু করে বেন জনসন, জন ফ্লেচার, ফ্রান্সিস ব্যুমন্ট, কনসিভ, ফিলিপ ম্যাসিঞ্জার, টমাস অটগুয়ে, হেনরি ফিল্ডিং; শ্রেরিভজন প্রমূখের লেখা নাটক মঞ্চস্থ হতো।
যেসকল নাটক ক্যালকাটা থিয়েটারে হয়েছে। তা হলো- শেক্সপীয়রের দি মার্চেন্ট অফ ভেনিস, ম্যাকবেথ, ওথেলো, হ্যামলেট, টমাস অটওসের ভেনিস
প্রিজার্ভড় এবং শেরিডানের স্কুল ফর স্ক্যাবল। দি নিউ প্লে হাউসে ক্যাপ্টেন কল নামক
একব্যক্তি অভিনয়ের মাধ্যমে এমন খ্যাতি অর্জন করেন যে সেই সময় তাঁকে 'গ্যারিক অফ দি
ইস্ট’ বলা হতো। এছাড়াও ব্যান্ডেল, পোলার্ড, ফ্রিট উড, রবিনসন, জেমস কাটল প্রমুখ অভিনেতা
এবং মিসেস হিউগেস, মিসেস হ্যারিটো, মিসেস বেসেট এমুস অভিনেত্রী প্রসিদ্ধি অর্জন করে।
একটানা তেত্রিশ বছর নাট্যশালায়
অভিনয়ের পর ১৮০৮ সালে ক্যালকাটা থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। রাজা গোপীমোহন ঠাকুর নাট্যশালা
কিনে সেখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন নাম দেয়া হয় নিউ চায়না বাজার।
নিউ প্লে হাউস বন্ধ হওয়ার কারন-
* থিয়েটারের শেয়ারের মূল্য
ধীরে ধীরে হ্রাস করা হয়েছিল।
* ১৭৯৫ সালে রুশ মনীষী লেবেদেফ
বেঙ্গলী সিসেটার প্রতিষ্ঠা করে। এই থিয়েটারের প্রভাব পড়তে পারে নিউ প্লে হাউস এ।
* অন্যদিকে চৌরঙ্গী থিয়েটারের
আবির্ভাব। ১৮১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চৌরঙ্গী থিয়েটার।
মিসেস
ব্রিস্টোর প্রাইভেট থিয়েটার(Mrs. Bristwo’s Private Theatre):
তৎকালীনসময়ে অসামান্য সুন্দরী
ও নৃত্যকুশলী এমা র্যাংহাম কলকাতার সিনিয়র মার্চেন্ট জন ব্রিস্টোকে বিবাহ করে নৃত্য
অঙ্গন ছেড়ে নাট্যমঞ্চে আসেন। ১৭৮৯ সালে চেীরঙ্গীর বাড়িতে প্রাইভেট থিয়েটার নির্মাণ
করেন মিসেস ব্রিস্টোর। যা ছিল মহিলাদের দ্বারা অভিনীত ও পরিচালিত প্রথম থিয়েটার। পুওর
সোলজার, সুলতান ও প্যাডলক নাইট নাটক তিনটি মঞ্চস্থের পরের বছর মিসেস ব্রিস্টোর প্রাইভেট
থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
হোয়েলার
প্লেস থিয়েটার (Wheler Place Theatre):
ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিলের
সদস্য এডওয়ার্ড হোয়েলারের নামে কলকাতায় একটি রাস্তা ছিল। এই রাস্তার পাশে ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের
২১ ফেব্রুয়ারি হোয়েলার প্লেস থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। দি ড্রামাটিক, সেন্ট প্যাট্রিকস
ডে, থ্রি উইকস আফটার ম্যারেজ, দি মোগল টেল, দি মাইনর, দি ডেপ লাভার, দি লায়ার, দি ক্রিটিক
ইত্যাদি নাটক, অপেরা ও প্রহসন মঞ্চস্থ হয়। বেশ কিছু নাটক মঞ্চস্থের পর ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের
নভেম্বর মাসে থিয়েটারটি বন্ধ হয়ে যায়।
এথেনিয়াম
থিয়েটার (Athenium Theatre):
ক্যালকাটা থিয়েটার বা দি নিউ
প্লে হাউস প্রতিষ্ঠার পরে মিসেস ব্রিস্টোর প্রাইভেট থিয়েটার ও হোয়েলার প্লেস থিয়েটার
প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলি ছিল স্বল্পস্থায়ী। ক্যালকাটা থিয়েটার বন্ধ(১৮০৮) হয়ে যাবার
পরে মিস্টার মরিস নামক এক ব্যবসায়ীর ১৮১২ সালে ১৮ নং সার্কুলার রোডে দুশো দর্শকাসন
বিশিষ্ট এথেনিয়াম থিয়েটার নামে নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রবেশ মূল্য ছিল এক মোহর।
আর্ল অফ এসেক্স, রেজিং দি উইন্ড, হ্যামলেট, লাইং ভালেট, দি ম্যাজিক পাইপ ও ড্যানসিং
ম্যাড নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু উপযুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী না থাকায়, নাট্য সমূহ দর্শকদের
প্রশংসা পায় না। ফলে মাসখানেক বাদেই এথেনিয়াম থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
চৌরঙ্গী থিয়েটার (Chowringhee Theatre):
দি নিউ প্লে হাউস বন্ধ হয়ে যাবার পর বেশকিছু অভিজাত ও শিক্ষিত ইংরেজরা কলকাতায় একটি স্থায়ী ভালো নাট্যমঞ্চের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। নাট্যরসিক শিক্ষিত ইংরেজদের এমেচার ড্রামাটিক সোসাইটি যা বিফস্টিক সোসাইটি নামেও পরিচিত ছিল। উক্ত ক্লাবের সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে ১৮১৩ সালে চৌরঙ্গি থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্য সকল ধিয়েটার থেকে এই ধিয়েটার
ছিল ব্যতিক্রম, কেননা এই থিয়েটার
তৈরি ও পরিচালিত হত অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডার দ্বারা। চৌরঙ্গী থিয়েটারের সঙ্গে বহু সংস্কৃত পণ্ডিত ও ভারতবিদ এইচ. এইচ. উইলসন থেকে শুরু করে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসন, ইংলিশম্যান কাগজের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক জে. এইচ. স্টোকলার, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ সহ আরো বিখ্যাত মানুষ ওতঃপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন চৌরঙ্গী থিয়েটারের সঙ্গে। ক্যাসল্ স্পেকটার, সিক্স টি থার্ড লেটার নাটক দিয়ে উদ্বোধন হয়।
তখন উপস্থিত ছিলেন
বড়লাট লর্ড ময়রা, তাঁর স্ত্রী এবং বহু নাট্যরসিক ব্যক্তিবর্গ।
একসময় চৌরঙ্গি থিয়েটার ঋণের
ভারে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে তখন বিক্রির জন্য নিলাম ডাকা হয়। ১৮৩৫ সালের ১৫ আগস্ট
এই নিলামে ত্রিশহাজার একশো টাকার সর্বোচ্চ দর দিয়ে চৌরঙ্গি থিয়েটার কিনে নেয় দ্বারকানাথ
ঠাকুর। পূণরায় শুরু হয় চৌরঙ্গি থিয়েটার। থিয়েটার পরিচালনার ভার দেওয়া হয় পার্কার, ক্লার্ক
এবং কার এই তিন অভিনেতার হাতে। বিলেতের ডুরি লেন থিয়েটার থেকে অভিনেত্রী মিসেস চেস্টারকে
নিয়ে আসা হয়। হঠাৎ ৩১ মে ১৮৩৯ রাতে বিধ্বংসী আগুনে থিয়েটার একেবারে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
দমদম
থিয়েটার (Dum Dum Theatre):
কলকাতায় চৌরঙ্গি থিয়েটার যখন
দারুণভাবে জনপ্রিয়, সেই সময় ১৮১৭ সালে দমদম অঞ্চলের দমদমের মিলিটারি ব্যারাকের কাছেই
দমদম থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই থিয়েটার খুব একটা বড়ো মাপের না হলেও অভিনয়ের গুণে এই
থিয়েটার অল্প সময়েই খ্যাতি অর্জন করে। জনপ্রিয়তার কারণে দমদম থিয়েটারকে বলা হতো ‘ইন্ডিয়ান
লিটিল ডুরি লেন থিয়েটার’। দমদম থিয়েটারের প্রাণপুরুষ চার্লস ফ্র্যাঙ্কলিং ছিলেন একজন
ব্রিটিশ সৈনিক। তিনি একাধারে থিয়েটারের পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা ছিলেন। তবে চার্লস
ফ্র্যাঙ্কলিং ১৮২৪ সালে মারা যাবার পর দমদম থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। চার্লস ফ্র্যাঙ্কলিং
এর মৃত্যুর খবর ইন্ডিয়া গেজেট পত্রিকায় শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখিতও হয়েছিল। এখানে যে
সকল নাটক অভিনীত হয়েছিল তার মধ্যে পেজেন্ট বয়, দি উইল, দি ওয়াটারম্যান, রাইভ্যালস,
ব্রোকেন সোর্ড, দি হানিমুন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বৈঠকখানা
থিয়েটার (Boithakkhana Theatre):
দমদম থিয়েটারের মতোই বৈঠকখানা
থিয়েটার স্বকীয়তায় নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।
১৮২৪ সালের ২৪ মে ১৭৭ বৈঠকখানা
রোডে বৈঠকখানা থিয়েটারের পথচলা শুরু হয়। এখানেও বেশ কিছু প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী অভিনয়
করতেন। তাঁদের মধ্যে মিসেস কোহেন এবং মিসেস ফ্রান্সিস ছিলেন সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।
দি লাইং ভ্যালেট, এ ট্রিপ টু ক্যালে, ফিউরিওসো, স্লিপিং ড্রাফট, মাই ল্যান্ডলেডিজ গাউন
ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ হয়। তবে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে নামকরা অভিনেত্রীরা বৈঠকখানা
থিয়েটার ছেড়ে চলে গেলে এটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
সাঁ
সুসি থিয়েটার (Sans Souci Theatre):
চৌরঙ্গি থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবার
৮০ দিনের মধ্যে ১৮৩৯ সালের ৩১ মে কলকাতার গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্ট ও ওয়াটারলু স্ট্রিটের
এক কোণে থ্যাকার স্পিংক কোম্পানির বইয়ের দোকানের নীচের বাড়িতে ‘ইউ কান্ট ম্যারি ইওর
গ্র্যান্ডমাদার’, ‘বাট হাউএভার’ এবং ’মাই লিট্ল এডপটেড’ নামক নাটক ও প্রহসন মঞ্চস্থের
মাধ্যমে চালু হয় চারশো দর্শকাসনের সাঁ সুসি থিয়েটার। প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী মিসেস লিচকে
সঙ্গী হিসেবে পেয়ে অভিনেতা ও সাংবাদিক স্টোকলার এই সাঁ সুসি থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।
টিকিটের মূল্য ছিল যথাক্রমে ছয় টাকা, পাঁচ টাকা ও চার টাকা। সুদৃশ্য এই রঙ্গালয়ে যে
সমস্ত নাটক অভিনীত হয়েছিল তার মধ্যে দি ওয়েদার কক, দি ওরিজিনাল, প্লেজেন্ট ড্রিমস,
দি লেডি অফ লায়ন্স, দি আইরিশ লায়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সাঁ সুসি থিয়েটারের স্থায়ী
থিয়েটারের জন্য এক হাজার টাকা করে অর্থসহায়তা প্রদান করেন বড়লাট অকল্যান্ড ও দ্বারকানাথ
ঠাকুর।
চিত্র
২: সাঁ সুসি থিয়েটার
দি মার্চেন্ট অফ ভেনিস-এর অভিনয় কলকাতায় তুমুল আলোড়ন তুলেতে সক্ষম হয় সাঁ সুসি থিয়েটার। ১৮৪১ সালের ৮ নভেম্বর মার্চেন্ট অফ ভেনিস অভিনয় চলাকালীন সময়ে মিসেস লিচের কাপড়ে আগুন লাগে। ১৮ নভেম্বর ১৮৪১ তারিখে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শেষপর্যন্ত তিনি মারা যান ।
অন্যান্য
থিয়েটার:
সাঁ সুসি থিয়েটার বন্ধ হয়ে
যাবার পরও বিদেশিদের নাচ্যচর্চা বন্ধ হয়ে যায় নি। বেশ কিছু বিদেশি থিয়েটার চলেছিল।
এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সেন্ট থিয়েটার, মিসেস লিউসের থিয়েটার রয়্যাল, ফোর্ট উইলিয়াম
থিয়েটার, গ্যারিসন থিয়েটার ইত্যাদি। একই সাথে গড়ে উঠেছিল নাট্যদল। নাট্যদলগুলির মধ্যে
হাডসন ড্রামাটিক কোম্পানি, দি এমেচার ড্রামাটিক সোসাইটি, এক্লিপস্ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এদের অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে রবিনসন ক্রুশো, মিকাডো, আলিবাবা, রবিনহুড, এ কান্ট্রিগার্ল,
অ্যান আইডিয়াল হাজব্যান্ড, অর্কিড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বিদেশি রঙ্গালয়ে বাংলঅ নাটক
না হলেও বাঙালি অভিজাতদের যাতায়েত ছিল। যেমন- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা এবং রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষভাবে যুব্ত ছিলেন থিয়েটারের সঙ্গে। আর বিদেশি
নাট্যশালা থেকে আগ্রহ তৈরি হত বাঙালিদের যাতে তারা উৎসাহ পেতেন থিয়েটার করার। তবে প্রশ্ন
এসে যায় বিদেশিরা আগমনের আগে কি আমাদের নিজেস্ব নাট্য ছিল না? উত্তরে আসবে ছিল। পূর্বেই
উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের যাত্রার কথা। যা ঐতিহ্যমন্ডিত কোনো লোকবিষয়কে নাট্যরূপ দিয়ে
অভিনয় প্রদর্শন করা হত। ”বাংলাদেশের বৃহত্তর যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহী,
দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে যাত্রার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।“৫ ইংরেজদের অবস্থান কালে কলকাতায় আসলেন রাশিয়ার
ভদ্রলোক গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ।
লেবেদেফ
ও বেঙ্গলী থিয়েটার
গেরাসিম স্তেপালেভিচ লেবেদেফ(১৭৪৯-১৮৯৭)
রাশিয়ার ইউক্রেনের এক কৃষক
পরিবারে তার জন্ম। তার মাতৃভাষা রুশ। তবে নিজ চেষ্টায় ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান সংস্কৃত,
হিন্দুস্থানি ও বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেন।
তিনি ছিলেন একাধারে অনুবাদক,
নাট্যপ্রযোজক, রুশ অভিযাত্রী, ভাষাবিদ, সংগীতজ্ঞ এবং লেখক। এছাড়াও তিনি ছিলেন ’ভারতবিদ্যা’৬ বিষয়ের পন্ডিত। লেবেদেফ সংগীতে দক্ষতার জন্য
এক রাজপুত্রের সংস্পর্ষে আসেন। তার সাথে ঘুরতে প্যারিস যায়। সেখানে ভারতীয় দোকান দেখেন।
১৯৭৫ সালে যাত্রীবাহী জাহাজে ১৫ই আগস্ট মাদ্রাস (বর্তমান চেন্নাই) পৌঁছান। সেখানে মেয়র
তাকে সংবর্ধিত করেন। কয়েকটি আসরে গান পরিবেশন করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করেন। তবে রক্ষশীল
সমাজে প্রবেশাধিকার না পেয়ে ১৭৮৫ মতান্তরে ১৭৮৭ সালে কলকাতা আসেন।
কলকাতা এসে লেবেদেফ জনৈক স্কুল-শিক্ষক
গোলোকনাথ দাসের সহযোগিতায় বাংলা, হিন্দুস্থানি ও সংস্কৃত ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। সংগীতজ্ঞরুপে
প্রতিষ্ঠা পান। তার টিকিটের মূল্য ছিলো ১২ টাকা।
কলকাতায় "দ্য বেঙ্গলি
থিয়েটার" গড়ে তোলেন ২৫ নম্বর ডোমনার (এজরা স্ট্রীট) একটি বাড়িতে।
তিনি জড্রেল রচিত দ্য ডিজগুয়িজ(The
disguise) এর অনুবাদ করেন "কাল্পনিক সংবদল" নামে। তিনি দশজন অভিনেতা ও ৩
জন অভিনেত্রীকে শিক্ষা দিয়ে নাটকটি ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর একটি অঙ্কের অভিনয়
করান। ২য় বার এই নাটকের অভিনয় হয় পরের বছর ১৭৯৬ সালের ২১ মার্চ। এবার ১ম ও ৩য় অংক বাংলায়,
২য় অঙ্কের ১শ দৃশ্য হিন্দুস্থানিতে ২য় দৃশ্য বাংলায় ও তয় দৃশ্য ইংরেজীতে। তাঁর প্রচেষ্টায়
বাংলা নাট্য প্রদর্শনী শুরু হয়।
লেবেদেফ কিংবা ইংরেজরা মূলত
এদেশে এসছেন ব্যবসা বানিজ্য করতে ঘটনা ক্রমে তারা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন।
ইংরেজরা থিয়েটারকে নিজেদের অবসর বিনোদনের জন্য ব্যবহার করলেও লেবেদেফ ব্যবসায়িক চিন্তা
নিয়ে সূচনা করেছিল থিয়েটার। তিনি বাঙালিদের আগ্রহের কারণ অনুধাবণ করে ইংরেজদের মত থিয়েটার
করে সেখানে ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করিয়ে মঞ্চস্থ করান। দ্য ডিজগুয়িজ ও লাভ ইস দ্য
বেস্ট ডক্টর নামক নাটক দুটি অনুবাদের জন্য বাছাই করার কারণ জানিয়ে লেবেডেফ তার ’A
Grammer of the pure and Mixed East Indian Dialects, (1801), Introduction’ গ্রন্থে
লিখেছেন, 'I translated two English dramatic pieces, namely, The Disguise, and
Love is the Best Doctor, into the Bengali language; and having observed that
the Indians preferred mimicry and drollery to plain grave solid sense; however
purely expressed-l therefore fixed on those plays, and which were most
pleasantly. filled up with a group of watchmen, chokeydars, savoyards, canera,
thieves, ghoonia, lawyers, gumosta and amongst the rest a corps of petty plunderers.’৭
এসময় ইংরেজদের দুটি থিয়েটার
ছিল। লেবেদেফের সামাল্যে ঈর্ষান্বিত ইংজেরগন প্রত্যক্ষভাবে জোসেফ ব্যাটল নামে সিন পেন্টার
ও মিহে নামে এক রাজকর্মচারীর সাহায্যে লেবেদেফের থিয়েটারে আগুন লাগিয়ে দেয়। তবে একজন
ইংরেজ মহিলার সঙ্গে প্রনয় ও ব্যর্থতা লেবেদেফ এর জীবনের অন্যতম বিপর্যয়। এমন কি ঋণের
দায়ে তাকে আদালতে যেতে হয়। সর্বশেষ ১৮০১ সালের দিকে ব্রিটিশ কোম্পানির কর্তৃপক্ষ তাকে
বলকাতা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। লেবেদেফ দেশে ফিরে রাশিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করেন।
রাশিয়ার ফরেন কলেজের অনুবাদক ও কোর্ট কাউন্সিলর নিযুক্ত হন।
তিনি রাশিয়ার সম্রাটের অর্থে
"ইম্প্রিমের ইন্ডিয়েনে" নামক বাংলা ছাপাখানা স্থাপন করেন।
-
ব্যবহারোপযোগী অভিধান ও বাংলা পাটিগণিত প্রণয়ন
করে।
-
মলিয়ে রচিত লাভ ইজ দি ডক্টর নটিক বাংলায় অনুবাদ
করে।
-
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের অংশবিশেষ বা রুশ ভাষায়
অনুবাদ করেন।
তার অন্য গ্রন্থ হলোঃ ও গ্রামার
অব দি পিত্তর অ্যান্ড মিশ্রভ ইস্ট ইন্ডিয়ান ডায়ালেক্ট(লন্ডন, ১৮০১), অ্যান ইস্পার
শিয়াল কনটেমপ্রেশন দি ইস্ট ইন্ডিয়ান সিস্টেম অব ব্রাহ্মিনস(সেন্ট পিটার্সবার্গ, ১৮০৫),
এ কালেশন অব হিন্দুস্থানী অ্যান্ড বেঙ্গলী আর্যস ইত্যাদি।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই
লেবেদেফ মৃত্যুবরণ করেন। মস্কোর লেনিনগ্রাডে তার সমাধি রক্ষিত আছে।৮
সখের নাট্যশালা
লেবেদেফ প্রতিষ্ঠিত 'বেঙালী থিয়েটার' থেকে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার'
প্রতিষ্ঠার কালসীমাকে ধরে, অর্থাৎ ১৭৯৫ সাল থেকে ১৮৭২ আলের মধ্যবর্তী সময় সখের থিয়েটারের
বা শৌখিন রঙ্গালয়ের কাল সেইরকমই বাংলা নাট্যশালার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াসকাল রূপে চিহ্নিত।
বিদেশিদের অবসর বিনোদনের জন্য নাট্যচর্চার প্রণোদনায় দেশীয় ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের
আনন্দের জন্য বা আমোদ উপভোগের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চ। আবার অনেক
ক্ষেত্রে ইংরেজদের কাছে সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য দেশের বিত্তবানরা নাট্যশালা স্থাপন
করেছিলেন। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, উদ্দেশ্য যাই থোক না কেন সখের নাট্যশালাগুলি
প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা নাট্যচর্চা ও বাংলা রঙ্গমঞ্চে এক ধারাবাহিক অগ্রসরতা লাভ করেছে।
সখের নাট্যশালার বৈশিষ্ট্যঃ
১. সখের নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার পিছনে যেমন প্রতিষ্ঠাতাদের
ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি অভিনয় ও মঞ্চ ভাবনার ক্ষেতেও দর্শক রুচির তুলনায়
আয়োজকদের রুচি ও মতামত বেশি প্রতিফলিত হয়েছিল।
২. নাটক নির্বাচনের ক্ষেতে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা হত না।
৩. স্থায়ী না থাকলেও বাড়ির উঠান, দালান, নাটমন্দির ইত্যাদি
ব্যবহার করা হত।
৪. দর্শক আসনে যারা থাকতেন তারা আমন্ত্রিত হত আয়োজক দের ইচ্ছা
মত। প্রথম দিকে নিজ বাড়ি ও আমন্ত্রিত ইংরেজরা ছিল দর্শক।
৫. নাটক দর্শনের সুযোগ সকলের ছিলনা।
৬. সখের নাট্যশালা থেকে কোন অর্থ উপার্জন হত না। কেননা এ
সকল নাট্যশালা তৈরি হত নিজেদের জন্য এবং অতিথিদের জন্য।
তবুও বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে সখের নাট্যশালার অভিনয় নাঢ্য
প্রচেষ্টা আজ অগ্রগতির লিপিমালায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।
তৎকালিন সময়ে প্রিন্স দ্বারাকানাথ ঠাকুর বা অন্যান্য উচ্চবিত্তরা
নাটক দেখার সুযোগ পেত। এছাড়া অন্য বাঙালিরা ইংরেজদের থিয়েটারে নাটক দোসার সুযোগ পেত
না। প্রত্যেক জমিদারের বাড়িতে বিনোদনের জন্য মঞ্চ ছিল। সম্ভ্রান্ত বাঙালি জমিদার ও
নবাবরা কলকাতায় ইংরেজদের নাট্যমন্ত্র দেখে নিজেরা বাড়ির মধ্যে নাট্যশালা ও নৃত্যশালা
তৈরি করেন। সখের জন্য বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তারা নাট্যশালা তৈরি করেছিল বলে এর
নাম হয় সখের নাট্যশালা। অনেকদিন ধরে এসব নাট্যশালা চলতো না। বলা যায় আকাঙ্ক্ষা পূরণের
জন্যই এসব তৈরি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে অনেক জমিদার তাদের জমিদারিত্ব হারায় ফলে
তাদের নাট্যশালাও বন্ধ হয়ে যেত। ঐসময়ে যাদের অধিক অর্থ ছিল তারা জমিদারদের নিকট থেকে
কিনে নব্য জমিদার হয়। যাদের বাবু বলে অভিহিত করা হতা। তবে এদের বেশিভাগ ছিল অশিক্ষিত।
১৮৩০-১৮৭২ পর্যন্ত সখের নাট্যশালা চলেছি।
যাইহোক, বাংলায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার তৈরি নিয়ে ২টি মত পাওয়া
যায়-
১. সখের বসে।
২. ইংরেজদের থিয়েটার কেমন তা অনুধাবন বা পরীক্ষন করা ছিল
লক্ষ্য।
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু
থিয়েটার:
১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার
ঠাকুরের নারকেলডাঙ্গার বাগানবাড়িতে নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
একদিকে চৌরঙ্গী থিয়েটারের জনপ্রিয়তা অন্যদিকে উচ্চবিত্তদের
ইংরেজ প্রীতি ইত্যাদির কারণে বিদেশি রঙ্গালয়ের প্রভাবকে অতিক্রম করতে পারেনি ’হিন্দু
থিয়েটার'। অবশ্য নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠার আগেই অর্থাৎ ১৮৩১ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর 'সমাচার
দর্পন' পত্রিকায় লেখা হয় -
"ঐ নর্তনশালা ইঙ্গলন্ডীয় রীত্যানুসারে প্রস্তুত হইবেক এবং
তন্মধ্যে
যে সকল নাটক ক্রীড়া হইবে সে সকলি ইজঙ্গলণ্ডীয় ভাষায়।"৯
১ম মঞ্চস্থ করা হয় সংস্কৃত নাটকের ইংরেজি অনুবাদ। নাটকের
নাম: উত্তরারামচরিত। অনুবাদ করেন: এইচ. উইলসন। আর রচয়িতার নাম: ভবভূতি। এই নাটকে রাম
কর্তৃক সীতার প্রত্যাখ্যান ও তৎসঙ্গে পুর্নমিলন বর্ণিত রয়েছে। ১৪ই ডিসেম্বর ১৮৩১ সালে
'উত্তররামচরিত' নাটকের প্রথম অঙ্ক মঞ্চে অভিনীত হয়। সেই দিন শেক্সপীয়রের 'জুলিয়াস সিজার'
নাটকের পঞ্চম অঙ্কও অভিনীত হয়।
এইচ. উইলসন একাধারে অনুবাদ, অভিনয় করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন।
অভিনেতারা ছিলেন বাঙালি। তবে তাদের ইংরেজি শিখতে হয়েছে। শ্রীযুক্তবাবু প্রসন্নকুমার
ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দত্ত, বাবু- গঙ্গানারায়ণ সেন, বাবু মাধবচন্দ্র
মল্লিক ও শ্রীযুক্তবাবু হরচন্দ্রঘোষ প্রমুখ বিত্তবানরা ছিলেন হিন্দু থিয়েটারের কমিটিস্বরূপ।
শ্যামবাজারে নবীন বসুর নাট্যশালা:
বর্তমান শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে ছিল, প্রখ্যাত ধনী ও
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নবীন বসুর অট্টালিকা, উদ্যান, পুকুর। নবীন বসু তার নিজ বাড়িতে দুই
লক্ষ টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যশালা।
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত 'হিন্দু থিয়েটারের' মঞ্চ
দেখেই নবীন বসু নাট্যশালা তৈরি করেন ও অভিনয় পরিকিল্পনা করেন। একদিকে প্রসন্ন কুমার
ঠাকুরের 'হিন্দু থিয়েটার' বন্ধ হতে চলছে। অন্যদিকে নবীন বস্তুর নাট্যশালার সূচনা।
নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বেশ মতভেদ রয়েছে।
যেমন:-
* ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবল মিত্র, মহেন্দ্রনাথ
বিদ্যানিধি প্রমাস মনে করেন প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৩১ সাল।
* ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত
মনে করেন- প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৩৩ সাল।
* ড. দর্শন চৌধুরীর মতে নবীন বস্তুর নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাকাল
১৮৩৫ সাল।
ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি অবলম্বনে 'বিদ্যাসুন্দর'পালার
নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয় নবীন বসুর নাট্যশালায়।
নাটকের দৃশ্যগুলো বাড়ির বিভিন্নস্থানে হত। যেমন বীরসিংহের
দরবার হিসেবে বৈঠকখানা সজ্জিত ছিল। মালিনীর কুটির ও মালঞ্চ নির্বাচন করা হয় উদ্যানে।
সুন্দর বসেছিল পুকুরপাড়ে। সেজন্য দর্শকদের উঠে উঠে গিয়ে কখনো নবীন বস্তুর বৈঠকখানা,
কখনো উদ্যানে, পুকুরের পাড়ে গিয়ে অভিনয় দেখতে হতো।
রাত ১২ টা থেকে শুরু হয়ে ৬ টা পর্যন্ত বিদ্যাসুন্দর নাটকের
অভিনয় হতো। অবশ্য প্রথম প্রযোজনা একদিনে শেষ করা সম্ভব হয়নি। “দুই রাত ধরে চলেছিল বিদ্যাসুন্দর
নাটক।"১০
প্রথম দিকে মঞ্চ বিভিন্ন স্থানে(অর্থাৎ প্যাশন প্লে এর মতো)
হলেও পরে যে স্থানে স্থায়ীভাবে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল
সেখানেই সম্পূর্ণ নাটক শেষ হতো। দর্শকদের আর বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন হত না।
তখন মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল প্রসেনিয়াম স্টাইলে।
নবীন বসু তার নাট্যশালায় অভিনবত্বে চমকে দিলেন দর্শকদের বিলেত
থেকে যন্ত্রপাতি এনে আলোর ব্যবস্থা করলেন। তিনি আলোর কৌশলে ঝড়বিদ্যুৎ দেখালেন স্টেজে।
পাইওনীয়ার পত্রিকায়(২২ অক্টোবর ১৮৩৫) আলোর রকমারি ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়। স্টেজের স্টে-সেটিং, দৃশ্যপট ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত
করেন দেশীয় যন্ত্র (সেতার, সারেঙ্গি, পাখোয়াজ, বেহালা ইত্যাদি)।
বিদ্যাসুন্দর নাটকের চরিত্রে:-
সেকালের ছড়ায় গান বাঁধা হয়েছিল:
"নবীন বসু কালুয়া
রাজা বৈদ্যনাথ ভুলুয়া
বরাহনগরের শ্যামাচরণ
হলেন সুন্দর।”১১
সুন্দরের ভূমিকায় শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যার ভূমিকায়
অভিনয় করেছিলেন ১৬ বছরের বালিকা রাধামণি বা মনি। রানী ও মালিনীর ভূমিয়ায় দুই চরিত্রেই
অভিনয় করেন জয়দুর্গা নামে প্রৌঢ়া রমণী। বিদ্যার সাথী বা দাসীর ভূমিকায় অভিনয় করেন
রাজকুমারী বা রাজু নামের মহিলা। সমকালীন যাত্রায় বেশ জনপ্রিয় ছিল কালুয়া ও ভুলুয়া
চরিত্র। এতে এজন্য কালুয়া ও ভুলুয়া চরিত্র দুইটি সৃষ্টি করা হয় বিদ্যাসুন্দর নাটকে।
যাতে অভিনয় করেন, কালুয়া চরিত্রে নবীন বসু, ভুলুয়া চরিত্রে রাজা বৈদ্যনাথ বায়।
সখের নাট্যশালাসমূহে ইংরেজ থিয়েটারের আকর্ষণ তৈরি হলেও দেশীয়
রেশ বর্তমান ছিল। ”বিদ্যাসুন্দর পালাকে নাটকায়িত করে কালুয়া ও ভুলুয়া চরিত্রসৃষ্টি
করা এবং সঙ্গীত ব্যবহার করা সেই যাত্রার অনুষজ্ঞাত প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেল।”১২
নবীনবসুর শ্যামবাজার নাট্যশালা সমকালীন শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত
জনসমাজে বিশেষ উদ্দীপনা ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কেননা তৈরি হয়ে ছিল 'বিলেতী যাত্রা'
এবং 'স্বদেশী থিয়েটার’ এর মিশ্র রূপ নবীনবসুর নাট্যশালাই বাঙালির প্রথম নাট্যশালা যেখানে
অভিনয় হয়েছিল বাংলা নাটকের। থিয়েটারের এই চমক ও জাঁকজমক ইত্যাদি আমন্ত্রিত ইঙ্গবজ্ঞা
দর্শকদের মুগ্ধ করেছে নিশ্চয়ই।
ওরিয়েন্টাল থিয়েটার:
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও নবীনচন্দ্র বসুর পর তৃতীয় বাঙালি হিসেবে
নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের(দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা) উদ্যোগে ২৬৮ নম্বর চিৎপুর রোডে প্রতিষ্ঠিত
হয় ’দি ওরিয়েন্টাল' থিয়েটার।
১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারী
স্কুলে' ওরিয়েন্টাল থিয়েটার রঙ্গালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। নাট্যশালাটির বিস্তৃত কোন বর্ণনা
পাওয়া যায় না। নাট্যশালাটিতে গৌরমোহন আঢ্যের বাঙালি ছাত্ররা ইংরেজি নাটকে অভিনয় করতো।
সাঁ সুচি থিয়েটারের মিঃ ক্লিঙ্গার ছাত্রদের অভিনয় শিক্ষা দিতেন। ছাত্র-অভিনেতাদের মধ্যে
কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, প্রিয়নাথ সেন, দীননাথ ঘোষ, প্রিয়নাথ দত্ত প্রমুখেরা ওরিয়েন্টাল
থিয়েটারে অভিনয় করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙালি ছাত্ররা ইংরেজ শিক্ষকদের নিকট
বিদেশী থিয়েটারের অভিনয় রীতি ও প্রকরণে অভিজ্ঞতা লাভ করে পরবর্তী কালে তারা সখের নাট্যশালায়
অভিনেতা, নাট্য পরিচালক, নাট্য উপদেষ্টা রূপে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অর্থাৎ
তাদের শিক্ষা ব্যর্থ হয়নি।
চিত্র
৩: ওরিয়েন্টাল থিয়েটার।
১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর মিঃ ক্লিঙ্গারের পরিচালনায়
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের 'ওথেলো' নাটকের সার্থক মঞ্চস্থ হয়। পুনরায় ৫ অক্টোবর মঞ্চস্থ হয়।
এ নাটকে ’ইয়াগোর’ ভূমিকায় প্রিয়নাথ দে খুব খ্যাতি লাভ করেন।
শ্রীমতি ইলিস-এর পরিচালনায় উইলিয়াম শেক্সপিয়রের আরো ২টি নাটক
('মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ ও ”হেনরি দি ফোর্থ’) অভিনীত হয়।
১৭ মার্চ ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস' নাটকের ২য় মঞ্চায়নের সময় মিসেস
গ্রীগ নামে ইংরেজ মহিলা অভিনয় করেন পোর্শিয়া চরিত্রে। এই নাট্যশালায় বাংলা নাটকের অভিনয়
হয় নি। অবশ্য যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উপদেশে কেশবচন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তিরা চেষ্টা করেন
'ওরিয়েন্টার থিয়েটারে’ বাংলা নাটক ও দেশীয় বাদনের প্রচলন করতে। এমনকি - 'হিন্দু পেট্রিয়ট'
পত্রিকার সম্পাদক বোম্বাইয়ের গ্রান্ট রোডে থিয়েটারে দেশি ভাষায় অভিনয় হয়েছে উল্লেখ
করে কলকাতায়ও যাতে দেশী ভাষা ব্যবহার করা হয়- সে বিষয়ে তিনি অনুরোধ জানান। কিন্তু তা
হয় নি, ২ বছরের মধ্যেই ওরিয়েন্টাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যরা ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে বাংলা
ব্যবহারে ব্যর্থ হয়ে নতুন একটি নাট্য সম্প্রদায় গঠন করেন ১৮৫৭ সালে চড়কডাঙার টেগোর
ক্যাস্ল রোডে রামজয় বসাকের বাড়িতে। সেখানে রামনারায়ণ তর্করত্নের 'কুলীনকুলসর্বস্ব'
অভিনয় করেন। মূল উদ্যোক্তা হিসেবে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন প্রিয়নাথ বসু।
১৮৫৩ সালে ডেভিড হেয়ার একাডেমির বঙ্গমঞ্চের নাট্যপ্রয়া লক্ষ্য
করা যায়। ১৮৫৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি ডেভিড হেয়ার একাডেমির অস্থায়ী নাট্যমঞ্চে উইলিয়াম
শেক্সপিয়রের 'মার্চেন্ট অফ ভেনিস। ২য় বার অভিনীর হয়। অভিনয়ের প্রশংসা মিলে 'সংবাদ প্রভাকর'
এবং ‘বেঙ্গল- স্বরকরা' পত্রিকায়।
প্যারীমোহন বসুর জোড়াসাঁকো
থিয়েটার:
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নবীনচন্দ্র বসুর ভাইপো প্যারীমোহন
বসু তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তৈরি করেন জোড়াসাঁকো থিয়েটার। নাট্যশালাটির সাজসজ্জা ছিল
খুব সুন্দর। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে এই জোড়াসাঁকো থিয়েটারে শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার
অভিনীত হয় যা দেখার জন্য সেদিন চারশো দর্শক উপস্থিত ছিলেন। সিজারের ভূমিকায় মহেন্দ্রনাথ
বসুর অভিনয় সকলের উচ্চ প্রশংসা লাভ করে। অবশ্য প্রসন্নকুমার প্রতিষ্ঠিত হিন্দু থিয়েটারের
মত জোড়াসাঁকো থিয়েটারে ইংরেজি নাটকের অভিনয় ইংরেজি ভাষাতে মঞ্চস্থ করা হয়।
আশুতোষ দেব বা সাতুবাবুর বাড়ির
নাট্যশালা:
নবীনচন্দ্র বসুর নাট্যশালায় বিদ্যাসুন্দরের অভিনয়ের পর(১৮৩৫)
২০ বছরেরও অধিককালে বাঙালির নাট্যশালায় কোনো বাংলা নাটক মঞ্চস্থ হবার প্রামাণ্য তথ্য
পাওয়া যায়নি। ১৮৫৭ সালে তিনটি নাট্যশালা বাংলা নাটকের অভিনয় শুরু করে-সাতুবাবুর বাড়ির
নাট্যশালা, জয়রাম বসাকের নাট্যশালা এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ।
এর পরবর্তী সময়ে বাঙালিদের তৈরি নাট্যশালায় বাংলা নাটকের অভিনয় দেখা যায়। ১৮৫৭ সালের
৫ই সেপ্টেম্বর অভিনীত হয় 'মহাশ্বেতা'। আরো অভিনীত হয় 'শকুন্তলা'। ড. অজিত কুমার ঘোষের
'নাট্যতত্ত্ব ও নাট্যমঞ্চ' গ্রন্থে জানিয়েছেন- "শকুন্তলা নাটকের প্রথম অভিনয়ের
একমাস পরেই (১৮৫৭, মার্চ) প্রথম মৌলিক বাংলা নাটক রামনারায়ণ তর্করত্বের 'কুলীনকুলসর্বস্ব'
নাটকের অভিনয় হয়"।১৩ জড়োয়ার গহনা পরে শরৎচন্দ্র
যখন শকুন্তলার বেশে মঞ্চে প্রবেশ করেন, তা দেখে দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে যান। তাই শকুন্তলা
সম্পর্কে Hindu Intelligence পত্রিকাতে লেখা হয়েছিল - "To see simple
Shakuntolah clothed in the splendid garments of the richest Hindu girls and
decorated in the most precious jewels brings to our mind a painful sight of the
murder of truth and nature."১৪
বেলগাছিয়া নাট্যশালা:
পাইকপাড়ার দুই বিখ্যাত ধনী রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও তাঁর
ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ১৮৫৮ সালে তাদের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন বেলগাছিয়া
নাট্যশালা। তাদের সম্পর্কে 'শর্মিষ্ঠা' (১৮৫৯) নাটকের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় মাইকেল
মধুসূদন দত্ত কৃতজ্ঞচিত্তে লিখেছিলেন-
"যদি কোনোদিন আমাদের দেশে নাটক নামক শিল্পটির বিকাশ ঘটে, তাহলে উত্তরপুরুষেরা নিশ্চয় ভুলবেন না এই মহান ভদ্রমহোদয়গণকে,
যারা জাতীয় নাট্যশালার একেবারে ঊষালগ্নের বন্ধু।" ১৫
চিত্র
৪: বেলগাছিয়া ভিলা।
শ্রীহর্ষের সংস্কৃত নাটক রত্নাবলী(বাংলায় অনুবাদ করেন রামনারায়ণ
তর্করত্ন) নাটক দিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই বেলগাছিয়া নাট্যশালার উদ্বোধন হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রত্নাবলী নাটকের প্রথম অভিনয় দেখতে এসেছিলেন ছোটলাট হেলিডে সাহেব,
মিস্টার হিউম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নাট্যকার রামনারায়ণ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল
ঘোষ প্রমুখ। নাটকি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরে ইংরেজ দর্শকদের দিকে তাকিয়ে রত্নাবলী নাটকের
ইংরেজি অনুবাদ করলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এর মধ্য দিয়ে বেলগাছিয়া নাট্যশালার সঙ্গে
যুক্ত হন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি রচনা করলেন শর্মিষ্ঠা নাটক। যা বেলগাছিয়া নাট্যশালায়
১৮৫৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মঞ্চস্থ হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ২য় বার শর্মিষ্ঠা মঞ্চস্থ হয়। শর্মিষ্ঠা
নাটকের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন: প্রিয়নাথ দত্ত (যযাতি), কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (বিদূষক),
দীননাথ ঘোষ (শুক্রাচার্য), ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ (বকাসুর), হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (দেবযানী),
কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় (শর্মিষ্ঠা), চুনীলাল বসু (নট)। এছাড়াও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর
ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র সভাসদ হিসেবে অভিনয় করেন। শর্মিষ্ঠা নাটকের অভিনয় দেখে স্বয়ং
মধুসূদন এতই তৃপ্ত হয়েছিলেন যে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে তিনি চিঠিতে জানিয়েছিলেন,-
"As for my own feelings, they were, things to dream of, not to tell."।
মূলত বেলগাছিয়া নাট্যশালার জন্যই মধুসূদন লিখেছিলেন 'পদ্মাবতী',
'কৃষ্ণকুমারী', 'একেই কি বলে সভ্যতা', 'বুড়ো সালিখের ঘাড়ে রোঁ' নাটক ও প্রহসন।
ঠাকুরবাড়ির জোড়াসাঁকো নাট্যশালা:
১৮৬৫-র মে মাসে দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়িতে তার মেজ ছেলে গিরীন্দ্রনাথের
অংশে(৫ নং বাড়ি) জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,
সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। একই বছর জুন মাসে মঞ্চস্থ হয় মধুসূদনের
কৃষ্ণকুমারী নাটক। এরপর মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা। প্রাপ্ততথ্য মতে, কৃষ্ণকুমারী
নাটকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কৃষ্ণকুমারীর মায়ের ভূমিকায় এবং একেই কি বলে সভ্যতা প্রহসনে
পুলিশ সার্জনের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
উল্লেখিত নাট্যশালা ছাড়াও আরো বেশ কিছু সখের নাট্যশালা বাংলার
নাট্য ইতিহাসে ভূমিকা রেখেছে- রামজয় বসাকের নাট্যশালা, গদাধর শেঠের বাড়ির নাট্যশালা,
চুঁচুড়ার নরোত্তম পালের বাড়ির নাট্যশালা, বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ, মেট্রোপলিটান থিয়েটার,
পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়, শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিকাল সোসাইটি ও বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়
ইত্যাদি।
পেশাদারি থিয়েটার
সখের নাট্যশালার পরবর্তী সময়ে পেশাদারি থিয়েটারের প্রচলন
শুরু হয় বাংলায়। সমাজের ‘এলিট শ্রেণি’ নিজেদের আমোদের জন্য থিয়েটারের দিকে ধাবিত হত।
তবে থিয়েটার যখন থেকে ব্যবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল তখন জীবনের তাগিদে পেশা হিসেবে
গ্রহণ শুরু হয় থিয়েটারের। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে বর্তমান সময়ে এসেও থিয়েটারকে পেশা
হিসেবে গ্রহণে করতে অনিহা দেখা যায়। ইংরেজ ব্যতিত লেবেদেফের থিয়েটারের ব্যবসায়িক চিন্তাধারা
দেখা যায় ১৭৯৫ সালে। এর প্রায় ৩৫ বছর পর বাঙালীর দ্বারা প্রথম নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত
হয়। সেটি হল প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হিন্দু থিয়েটার যার সময়টা ছিল ১৮৩১ সাল।
এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় শ্যামবাজারের নবীন বসুর নাট্যশালা, ওরিয়েন্টাল থিয়েটার, প্যারীমোহন
বসুর জোড়াসাঁকো থিয়েটার, আশুতোষ দেবের (সাতুবাবুর) বাড়ির নাট্যশালা ইত্যাদি। তবে এগুলি
ছিল সখের নাট্যশালা। সামগ্রিক ভাবে সাধারণের কাছে এগুলি তখনো পৌঁছোতে পারেনি। এর অনেক
পরে ১৮৭২ প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল থিয়েটার।, যা প্রথম বাংলা পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ।
সাধারণ রঙ্গালয় বা ন্যাশনাল
থিয়েটার:
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ৩৬৫ আপার চিৎপুর রোডে মাইকেল
মধুসূদন সান্যালের বাড়িতে (বর্তমানে ২৭৯এ-এফ রবীন্দ্র সরণি) দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ'
নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা হয়। প্রতিষ্ঠার অবদান ছিল বাগবাজার
এমেচার থিয়েটার (প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭) এবং শ্যামবাজার নাট্যসমাজ (প্রতিষ্ঠা ১৮৭২, মে ১১)
এই দুই নাট্যশালার। যাঁদের উদ্যোগে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি,
অমৃতলাল বসু ও ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়।
চিত্র ৫: সাধারণ রঙ্গালয় বা
ন্যাশনাল থিয়েটার।
সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে অভিনীত হল
দীনবন্ধু মিত্রের জামাইবারিক ১৪ ডিসেম্বরে, ২১ ডিসেম্বর নীলদর্পণ এবং ২৮ ডিসেম্বর সধবার
একাদশী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে নীলদর্পণ নাটকের দ্বিতীয় অভিনয়ের পর ইংরেজ শাসকদের মধ্যে
চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অমৃতলালের স্মৃতিকথায় উল্লেখ আছে; "নীলদর্পণ অভিনীত হইবার
সময় এক রাত্রিতে (২১.১২.১৮৭২) পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ডাইলস সাহেব আসিয়াছেন শুনিয়া
অনেকে মনে করিল যে তিনি দু'চারজনকে ধরিয়া লইয়া যাইবেন। তাহাতে কেহই দমিয়া গেল না, বরং
সকলেরই ফুর্তি বাড়িয়া গেল; তোরাপবেশে মতিলাল আস্ফালন করিয়া বলিল, 'ধরে নিয়ে যাবে। আমি
এই লুঙ্গি পরেই যাব'।"
”অমৃতলাল ১৮৭৫ সালে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার পদে
নিযুক্ত হন। প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতায় আগমন এবং একজন রাজভক্তের চাটুকারিতাকে ব্যঙ্গ
করে রচিত ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসনে অভিনয় করার কারণে পুলিশ অমৃতলাল বসুকে গ্রেফতার
করে।”১৬
রঙ্গমঞ্চে নীলদর্পণ নাটককে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক চেতনার
উন্মেষ ঘটে। এই নাটকের অভিনয় দেখতে-দেখতে কখনো-কখনো ইংরেজশাসক সম্প্রদায় উত্তেজিত হয়েছেন।
কখনোবা স্বদেশবাসী। সাধারণ রঙ্গালয়-এ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে অভিনীত হলো: নবীন তপস্বিনী
(৪ জানুয়ারি), লীলাবতী (২১ জানুয়ারী), বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৫ জানুয়ারি), নবীন তপস্বিনী
(১৮ জানুয়ারি), নবনাটক (২৫ জানুয়ারি), নীলদর্পণ (১ ফেব্রুয়ারি), নয়শো রুপেয়া (৮ ফেব্রুয়ারি),
জামাইবারিক (১৫ ফেব্রুয়ারি)। একমাত্র শিশির ঘোষের 'নয়শো রুপেয়া' ছাড়াবাকি সব নাটকই
দীনবন্ধু মিত্রের লেখা। ঐ সমস্ত নাটকগুলির সঙ্গে কুজার কুঘটন, নববিদ্যালয়, পাক্কাতামেশা,
পরীস্থান ইত্যাদি প্রহসনগুলি মঞ্চস্থ হয়েছিল।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ সাধারণ রঙ্গালয়ের দলবদ্ধ শেষ
অভিনয়ের পর দল ভেঙে যায়। দল ভেঙে যাওয়ার পেছনে বিবিধ কারণ ছিল, তার মধ্যে উল্লেখ্য
হল:
১. খ্যাতির বিড়ম্বনা-পারস্পরিক মনোমালিন্য;
২. ব্যক্তিত্বের সংঘাত-একই দলে একাধিক ভালো অভিনেতা;
৩. অভিনয় উপযোগী সাজসরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধা;
৪. বর্ষায় খোলামঞ্চে অভিনয়ে বাধা।
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার:
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর ৬ নং বিডন স্ট্রিটে(অধুনা
মিনার্ভা থিয়েটার) মহেন্দ্রনাথ দাসের জমিতে নির্মিত হয় কাঠের থিয়েটার বাড়ি। তিষ্ঠাতার
নাম ভুবনমোহন নিয়োগী। অন্যদিকে বেঙ্গল থিয়েটার ততদিনে দারুণভাবে অভিনয় চালাচ্ছে, ঠিক
তখনই প্রতিষ্ঠিত হলো গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার। ১৮৭৩-এর ৩১ ডিসেম্বর এই থিয়েটারে প্রথম
মঞ্চস্থ হয় অমৃতলাল বসুর কাম্যকানন। কিন্তু অভিনয়ের সময় আগুন লেগে মঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। এত থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। তবু দুর্ঘটনার পরের দিন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার বেলভেডিয়ারে
নীলদর্পণ মঞ্চস্থ করে। নতুন উৎসাহে থিয়েটার বাড়ি পুননির্মাণ করে ১৮৭৪-এর ১০ জানুয়ারি
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার মঞ্চস্থ করে উমেশচন্দ্র মিত্রের বিধবাবিবাহ। এরপরে ঐ বছরেই
১৭ জানুয়ারি মনোমোহন প্রণয়পরীক্ষা, ২৪ জানুয়ারি মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী, ৭ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি
বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা অভিনীত হয়।
বেঙ্গল থিয়েটার:
ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবার পরে ১৮৭৩-এর ১৬ আগস্ট ৯
নং বিডন স্ট্রিটে বিখ্যাত ধনী সাতুবাবুর বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে বেঙ্গল থিয়েটার নির্মিত
হয়। যাতে পাঁচহাজার টাকার অধিক ব্যয়ে হয়। লিউসের লাইসিয়াম থিয়েটারের অনুকরণে বেঙ্গল
থিয়েটার নামক নাট্যশালাটি নির্মিত হয়। বেঙ্গল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সাতুবাবুর দৌহিত্র
শরৎচন্দ্র ঘোষ।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটকের
অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এরপরে ১৮৭৩-এর ৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীনারায়ণ
দাস রচিত মোহান্তের এই কি কাজ মঞ্চস্থ করে বেঙ্গল থিয়েটার। বর্ধমানের মহারাজা বেঙ্গল
থিয়েটারের রত্নাবলী ও কৃষ্ণকুমারী নাটকের অভিনয় দেখে প্রীত হয়ে এই থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক
হন। সেই উপলক্ষে ১৮৭৩-এর ১২ ডিসেম্বর বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপ অভিনীত হয়।
১৯০১ সালের ২০ এপ্রিল বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে বেঙ্গল থিয়েটার চিরতরে বন্ধ
হয়ে যায়। কিন্তু বেঙ্গল থিয়েটার নানা কারণেই বাংলা নাট্যমঞ্চে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার
করে আছে- পেশাদারি থিয়েটার, অভিনেত্রী গ্রহণ এক অভিনব দুঃসাহাসিক প্রচেষ্টা, নাট্যমঞ্চে
বঙ্কিমচন্দ্রকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা এবং বিহারীলালের নাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা।
স্টার থিয়েটার:
কলকাতার ধনী ব্যবসায়ীর পুত্র গুর্মুখ রায় থিয়েটার প্রমোদের
মোহে এবং বিশেষ করে বিনোদিনীর আকর্ষণে থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের
২১ জুলাই মাসে বাগবাজারের কীর্তিচন্দ্র মিত্রের ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটের খালি জমি ইজারা
নিয়ে গুর্মুখ রায়ের অর্থে এবং গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র প্রমুখের তত্ত্বাবধানে
নতুন 'ইষ্টক নির্মিত' পাকা রঙ্গালয় তৈরী হল এবং 'স্টার থিয়েটার' নামে তা রেজিষ্ট্রি
করা হল।
চিত্র ৬: স্টার থিয়েটার।
শনিবার গিরিশের 'দক্ষযজ্ঞ' নাটক দিয়ে স্টারের গৌরবময় যাত্রা
শুরু হল। গুর্মুখ রায় স্টারে মোট ছয় মাস মালিক থাকাকালীন অভিনীত হয় - ১৮৮৩ : 'দক্ষযজ্ঞ'
(২১- জুলাই), 'ধ্রুবচরিত' (১১ আগস্ট), 'সীতার বনবাস' (২৬ সেপ্টেম্বর) 'চক্ষুদান' (২৭
অক্টোবর), 'মেঘনাদ বধ' (২১ নভেম্বর), 'সধবার একাদশী' (৫ ডিসেম্বর) প্রভৃতি নাটক। এই
ছয় মাসে দীনবন্ধু, রামনারায়ণ, অমৃতলালের একটি নাটক, 'মেঘনাদ বধ'-এর নাট্যরূপ ছাড়া আর
সবই গিরিশের লেখা নাটক এবং গিরিশের সব নাটকই পৌরাণিক নাটক। 'দক্ষযজ্ঞের' পর 'ধ্রুবচরিত'
ও 'নলদময়ন্তী' নাটক দুটি খুবই সাফল্যলাভ করেছিল। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে গুর্মুখ
রায় আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের লোকজনের চাপে এবং ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে স্টারের স্বত্ব
ছেড়ে দিতে চান এবং ১৮৮৪-র জানুয়ারি মাসে গুর্মুখ রায় মাত্র এগোরো হাজার টাকায় অমৃতলাল
মিত্র, দাসুচরণ নিয়োগী, হরিপ্রসাদ বাবু ও অমৃত লাল বসু- এই চারজনকে স্টারের স্বত্ব
বিক্রি করে দিলেন।
এমারেল্ড থিয়েটার:
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্টার থিয়েটারের জমি কিনে নিয়ে ৬৮ নং বিডন
স্ট্রিটে পুরো নবরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় এমারেল্ড থিয়েটার। ১৮৯০ সালে যেসমস্ত নাটক এমারেল্ড
থিয়েটার মঞ্চস্থ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: মৃণালিনী (নাট্যরূপ গিরিশ), বিষবৃক্ষ
(নাট্যরূপ অতুলকৃষ্ণ), কপালকুণ্ডলা (নাট্যরূপ অতুলকৃষ্ণ), আনন্দমঠ (নাট্যরূপ গিরিশ),
নবীন তপস্বিনী (দীনবন্ধু) ইত্যাদি।
বীণা থিয়েটার:
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর ৩৮ নং মেছুয়াবাজার রোডে(ঠনঠনিয়া)
কবি ও নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় প্রতিষ্ঠা করেন বীণা থিয়েটার। রাজকৃষ্ণ রায়ের একটি নিজস্ব
ছাপাখানা ছিল। সেখানে থেকে 'বীণা' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন তিনি। তাঁর তৈরি
নাট্যমঞ্চের নামও রাখলেন 'বীণা’ থিয়েটার।
সিটি থিয়েটার:
রাজকৃষ্ণ রায় যখন বীণা থিয়েটার চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে
পড়েন, তখন ১৮৯১-তে নীলমাধব চক্রবর্তী বীণা থিয়েটার ভাড়া নিয়ে তৈরি করেন সিটি থিয়েটার।
মঞ্চস্থ হল গিরিশের চৈতন্যলীলা। গিরিশ ছিলেন সিটি থিয়েটারের মুখ্য পরামর্শদাতা ও নাট্যকার।
তাঁর ছেলে দানীবাবুও এখানে অভিনয় করেন। ১৮১১ সালে যে-সমস্ত নাটক সিটি থিয়েটারে মঞ্চস্থ
হয় তার মধ্যে চৈতন্যলীলা (১৬ মে), সরলা (১৭ মে), বিশ্বমঙ্গল (৩১ মে), সীতার বনবাস
(১৭ জুন), নলদময়ন্তী (২০ জুন), বুদ্ধদেবচরিত (১৮ জুলাই) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৮৯২
সালে এই সিটি থিয়েটারে যেসমস্ত নাটক অভিনীত হয় তার মধ্যে সরলা, বিশ্বমঙ্গল, বেল্লিকবাজার,
বুদ্ধদেবচরিত, ভোটভেল্কি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৮৯২ সালের ৮ এপ্রিল সরলা ও তাজ্জব ব্যাপার-এর
অভিনয় এরপরেই সিটি থিয়েটারের প্রথম পর্বের অভিনয় শেষ হয়ে যায়।
মিনার্ভা থিয়েটার:
১৮৯৩-এর ২৮ জানুয়ারি ৬ নং বিডন স্ট্রিটে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের
দৌহিত্র নাগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় মিনার্ভা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের
২৮ জানুয়ারিতে মিনার্ভা থিয়েটারের উদ্বোধন হয় শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ(অনুবাদ গিরিশ) নাটকের
অভিনয়ের মাধ্যমে। গিরিশ এর পরে মঞ্চস্থ করলেন নৃত্যগীতের নাটক 'মুকুলমঞ্জুরা' ও 'আবুহোসেন'।
এই দুই নাটক বিপুল জনপ্রিয়তা পেল ও প্রচুর আয় হল।
চিত্র ৭: মিনার্ভা থিয়েটার।
সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে মিনার্ভা থিয়েটার পর পর বেশ কিছু নাটকের
অভিনয় করে। তার মধ্যে সপ্তমীতে বিসর্জন (১১ অক্টোবর, ১৮৯৩), জনা (২৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৩),
নলদময়ন্তী (২৪ ডিসেম্বর, ১৮৯৩), বড়দিনের বশিস (২৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৩), প্রফুল্ল (২৪ মার্চ,
১৮৯৪), করমেতিবাঈ (১৪ জুলাই, ১৮৯৪), পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস (১৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪), সধবার
একাদশী (২৫ নভেম্বর, ১৮৯৪), দক্ষযজ্ঞ (২৫ জানুয়ারি, ১৮৯৫), পলাশীর যুদ্ধ (২২ ফেব্রুয়ারি,
১৮৯৫) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য যে বড়দিনের বখশিস ও পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস
অভিনয়ের সময় ব্রিটিশ পুলিশ নাটকের অভিনয় বন্ধ করার চেষ্টা করে। প্রথমটিতে বড়দিনকে ব্যঙ্গ
করা হয়েছে ও দ্বিতীয়টি অশালীন-এই অভিযোগ ছিল।
ক্লাসিক থিয়েটার:
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে অমরেন্দ্রনাথ
দত্ত প্রতিষ্ঠা করেন ক্লাসিক থিয়েটার। প্রথম দিন মঞ্চস্থ হয় গিরিশের নলদময়ন্তী, তৎসহ
প্রহসন বেল্লিকবাজার।
ক্লাসিক থিয়েটারের অভিনয় শুরু হয়ে বাংলা নাট্যমঞ্চে নতুন
জীবন সঞ্চারিত হল। ক্লাসিক থিয়েটারে উল্লেখযোগ্য অভিনয়ের একটি তালিকা দেওয়া হচ্ছে:-
১৮৯৭: নলদময়ন্তী ও বেল্লিকবাজার (১৬ এপ্রিল), পলাশীর যুদ্ধ
ও লক্ষ্মণবর্জন (১৭ এপ্রিল), দক্ষযজ্ঞ (১৮ এপ্রিল), বিবাহবিভ্রাট (২৪ এপ্রিল), হারানিধি
(১ মে), বিল্বমঙ্গল (২৩ মে), বুদ্ধদেবচরিত (৩০ জুন), রাজা ও রানী (২৪ জুলাই), আলিবাবা
(২০ নভেম্বর), আলাদীন (১২ ডিসেম্বর)। ১৮৯৮ : পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস (৮ জানুয়ারি), দোললীলা
(৫ মার্চ), মেঘনাদবধ (১৬ জুলাই), প্রফুল্ল (২৭ আগস্ট), ইন্দিরা (২৪ সেপ্টেম্বর), কমলেকামিনী
(৫ নভেম্বর)। ১৮৯৯: জনা (৮ জানুয়ারি), রাজা ও রানী (১৫ জানুয়ারি), ধ্রুবচরিত্র (২২
ফেব্রুয়ারি), সীতার বনবাস (৮ মার্চ), প্রফুল্ল (১৮ মার্চ), আবুহোসেন (১২ এপ্রিল), চক্ষুদান
(১৩ মে), করমেতিবাঈ (১৫ জুলাই), ম্যাকবেথ (১৮ নভেম্ভবর)। ১৯০০: দেবীচৌধুরানী (১ জানুয়ারী),
বিশ্বমঙ্গল (৭ জানুয়ারি), আলিবাবা (১৭ জানুয়ারি), পাণ্ডবগৌরব (১৭ ফেব্রুয়ারি), সীতারাম
(৩০ জুন), সরলা (৩১ জুলাই), সধবার একাদশী (২০ আগস্ট), বৃষকেতু (৫ সেপ্টেম্বর)। ১৯০১:
চাবুক (১ জানুয়ারি), অশ্রুধারা (২৬ জানুয়ারি), কপালকুণ্ডলা (১ জুন), মৃণালিনী (২৭ জুলাই),
চৈতন্যলীলা (১৪ সেপ্টেম্বর), অভিশাপ (২৮ সেপ্টেম্বর)। ১৯০২: বহুত আচ্ছা (১৮ জানুয়ারি),
ফটিকজল (১২ এপ্রিল), ভ্রান্তি (১৯ জুলাই), আয়না (২৫ ডিসেম্বর)। ১৯০৩: প্রতাপাদিত্য
(২৯ আগস্ট), নীলদর্পণ (১২ সেপ্টেম্বর), হিরণ্ময়ী (১৪ নভেম্বর)। ১৯০৪: ভ্রমর (৩ মার্চ),
সৎনাম (৩০ এপ্রিল), পৈয়ার (১ জুন), তরণীসেনবধ (২৩ জুলাই), বিক্রমাদিত্য (২৪ জুলাই),
চোখের বালি (২৭ নভেম্বর)। ১৯০৫: কোনটা কে? (১২ ফেব্রুয়ারি), প্রেমের পাথারে (২ মার্চ),
শিবরাত্রি (৪ মার্চ), সংসার (৪ মার্চ), পৃথ্বীরাজ (৪ নভেম্বর), প্রণয় না বিষ (২৩ ডিসেম্বর),
এস যুবরাজ (৩০ ডিসেম্বর)। ১৯০৬: সিরাজদৌল্লা (২৭ জানুয়ারি)।
অন্যান্য পেশাদার থিয়েটারের মধ্যে রয়েছে- আরোরা থিয়েটার,
কোহিনূর থিয়েটার এবংস্টার থিয়েটার(হাতিবাগান) ইত্যাদি।
ঢাকার নাট্যচর্চা
উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকায় কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি(১৮৬৫), ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ(১৮৯০-৯২ এর মধ্যে), ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার(১৮৯৭) ইত্যাদি। এ সময় মুন্সিগঞ্জ শহরে ‘জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যা এখনও বর্তমান। “নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে শহরের জগধাত্রী মন্দির সংলগ্ন নাট্য মঞ্চ অগ্রনী ভূমিকা পালন করে।”১৭
পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ১৮৬৫ সালে (মতান্তরে ১৮৭০-৭২ সালের মধ্যে) পুরান ঢাকায় বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানে জমিদার মোহিনীমোহন দাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। একে কেন্দ্র করে একটি নাট্যসমাজও গড়ে উঠেছিল। ১৮৭২ সালে রামাভিষেক নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে এই রঙ্গমঞ্চই ঢাকায় প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যাভিনয় শুরু করে। টিকেটের হার ছিল চার, দুই ও এক টাকা, যা সময়ের বিবেচনায় ছিল অনেক বেশি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত রামাভিষেক নাটকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
”ঢাকার নাট্যচর্চায় নবাব বাড়ির পরোক্ষ অবদান ছিল। নবাবরা একই সাথে নিজেদের ও ঢাকাবাসীর জন্য নাট্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। নবাবদের ইংরেজ সরকার কর্তৃক পদক বা উপাধি প্রাপ্তি, খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপন, পুত্রকন্যার বিবাহের মত উৎসবে যেখানে ঢাকাবাসী ও ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয়রা আনন্দের সামিল হতে পারবে সেখানে কলকাতা ও পার্সি নাট্যদলকে আমন্ত্রণ করতেন।”১৮
'প্রাইড অব বেঙ্গল থিয়েটার’ (১৮৬১) নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ভাড়া নিয়ে অভিনয় করত। তবে এ মঞ্চে শুধু নাটকই প্রদর্শিত হতো না, ঢাকার অধিকাংশ সভাও এখানেই অনুষ্ঠিত হতো। এদিক থেকে এটি তখন টাউন হলের প্রয়োজন মিটিয়েছে। ১৮৭৩ সালে মোহিনীমোহন দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় এসে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে নীলদর্পণ, নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, যেমন কর্ম তেমন ফল, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, ভারত মাতা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ করে। ১৮৭৬ সালে নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে মুম্বাই থেকে একটি দল ঢাকায় এসে হিন্দি নাটক ইন্দ্রসভা মঞ্চস্থ করে। গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নবায়ন এই তিনবোন ইন্দ্রসভায় অভিনয় করেন। ঢাকায় মহিলাদের দ্বারা অভিনয় এই প্রথম। তাঁরা যাদুনগর নামে অপর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেন। ১৮৮৪ সালে এখানে অভিনীত হয় উত্তররামচরিত।১৯
ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ ১৮৯০ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে কোনও এক সময় পুরান ঢাকার নবাব বাড়ির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথমে ছিল ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চ; কিন্তু এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাউন থিয়েটার সেটি ভেঙ্গে নতুন করে মঞ্চ নির্মাণ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির কারণে মঞ্চটি এক সময় ইসলামপুরে স্থানান্তরিত হয়।
ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী কর্তৃক ১৮৯৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদার কিশোরীলাল প্রথমে ক্রাউন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এক সময় এর শিল্পী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমঝোতার অভাব দেখা দিলে তিনি ক্রাউন থিয়েটারের কতিপয় শিল্পী নিয়ে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে নবাব বাড়ির গেটের নিকটে, অর্থাৎ সাবেক লায়ন সিনেমা হলের জায়গায় মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল। ক্রাউন থিয়েটারের কতিপয় অভিনেতা-অভিনেত্রী ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারে’ যোগ দেয়ার ফলে ক্রাউন থিয়েটারের কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুকাল পরে ক্রাউন থিয়েটার চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করলে নাট্যমঞ্চ হিসেবে এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার কলকাতা থেকে অভিনেত্রী এনে ও স্থানীয় বাইজিদের দিয়ে অভিনয় করাত। এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: দুর্গেশনন্দিনী, দেবীচৌধুরানী, বিজয় বসন্ত, আলীবাবা, নবীন তপস্বিনী, বিল্বমঙ্গল, নন্দদুলাল, তরুবালা ইত্যাদি। টিকেটের হার ছিল দুই টাকা, এক টাকা, আট আনা ও চার আনা। ঢাকায় পেশাদার থিয়েটার প্রচলনের পেছনে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।২০
”বিশ শতকের প্রথম দিকে মীর্জা আবদুল কাদের ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার ক্রয় করে এর নতুন নামকরণ করেন লায়ন থিয়েটার।“২১ এখানে বাংলা নাটকের পাশাপাশি উর্দু নাটকও মঞ্চস্থ হতো। উর্দু নাটকগুলির মধ্যে ছিল জালমা ও পারাস্তা, বুলবুল এ বিমার ইত্যাদি। ঢাকার নাট্যকার যোগেন গুপ্তের চিড়িয়াখানা এবং বিপিন বিহারী চামের লাঞ্ছনা নামক দুটি প্রহসনও এখানে মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে ঢাকায় ফিল্মের আবির্ভাব হলে লায়ন থিয়েটারে নাটক প্রদর্শন বন্ধ করে ‘লায়ন সিনেমা’ নামে এটিকে প্রেক্ষাগৃহে পরিণত করা হয় এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। ২২
মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট ১৯৫০ সালে পুরনো ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাট্যরূপ বিজয়া-র প্রদর্শনী দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে বিজন ভট্টাচার্যের নাটক জবানবন্দি মঞ্চস্থ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ। ১৯৫২ সালে মঞ্চস্থ হয় সিকান্দার আবু জাফরের ঐতিহাসিক নাটক সিরাজউদ্দৌলা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডক্টরস ক্লাব ও কলেজ ছাত্র-সংসদ যথাক্রমে মানময়ী গার্লস স্কুল ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বীপান্তর এবং অগ্রদূত নাট্যসংঘ বিধায়ক ভট্টাচার্যের মাটির ঘর মঞ্চস্থ করে। নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি এ মঞ্চে অন্যান্য সভা-সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়।২৩
থিয়েটারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের সূচনালগ্নে সৌখিনতার আবরণে সুপ্ত ছিলো। গ্রামের একটা প্রবাদ আছে, "শখের তোলা আশি টাকা ।" শখের জন্য মানুষ যে কাজ করে তাতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে পারে। থিয়েটারে একটা সময় শখের প্রাধাণ্য পায়।
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য-বিভাগের অধ্যাপিকা ড. গীতা সেনগুপ্ত তার "বিশ্বরঙ্গালয় ও নাটক" গ্রন্থে 'নবনাট্য আন্দোলন ও আধুনিক যুগ' শিরোনামে লিখেছেন, "বাংলা থিয়েটারের প্রথম যুগ কেটেছে নবজাগরিত শিক্ষিত অভিজাত বাঙ্গালীদের সৌখিন নাট্যাভিনয় প্রচেষ্টায়।"২৪ কলকাতার মত পূর্ববঙ্গেও সুচনা
হয়েছিল সেীখিন নাট্যপ্রচেষ্ঠা দিয়ে। তবে কেউ কেউ ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে নাট্যচর্চা
করত। "ইসলামপুরের যেখানে 'লায়ান সিনেমা' কাদের সর্দার ওখানে 'পাসিয়ান থিয়েটার' নামে একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন।"২৫ "১৯৫১ সালে রূপশ্রী, 'দুই পুরুষ' নাটকটি মঞ্চস্থ করার জন্য সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হল তিন রাত্রির জন্য ভাড়া নেয়া হয় সেখানে তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খাঁ নুন বলেছেন, " East Bengal is
Fertile in Culture then Agriculture." অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ কৃষির চেয়ে কৃষ্টির ক্ষেত্রে অধিকতর উর্বর।"২৬
তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ নিয়মিত নাট্যচর্চা ছিল না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পর্ব উপলক্ষে নাটক মঞ্চস্থ হত। "মাওলানা বক্স সর্দার ও সামাদ মেম্বারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মঈনদ্দিন চৌধুরী মেমোরিয়াল মিলনায়তন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পেয়ে পুরান ঢাকায় নাট্যচর্চার উন্মেষ ঘটে।"২৭ "লালবাগ কম্যুনিটি সেন্টার হল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। বাংলাদেশের মফঃস্বল অনেক নাট্য গোষ্ঠী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।"২৮ পুরান ঢাকায় নাট্য গোষ্ঠীর নামের সাথে সৌখিন শব্দ যোগ নির্দেশ করে সৌখিন থিয়েটারকে। "মরহুম এজাজ খানের নেতৃত্বে পুরান ঢাকায় বাংলাদেশ সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ফেডারেশন গঠিত হয়।"২৯ এছাড়াও বেশ কিছু সৌখিন নাট্য গোষ্ঠীর নাম জানা যায়, বালার্ক সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী, একতা সৌখিন শিল্পী গোষ্ঠী, অপরূপ সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী, আনন্দম সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী, মঞ্চদূত সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী, পথিকৃৎ সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী, বিবর্তন সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ইত্যাদি। "১৯৪৯ সালে নাট্যকার গোলাম রহমান রচিত ও নির্দেশিত 'উদয়নালা' নাটকের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথম সৌখিন মহিলা অভিনেত্রীর আবির্ভাব ঘটে। তৎকালীন এম.এল.এ ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম এর অনুপ্রেরণায় তার স্ত্রী চাঁদপুরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা শিরিন চৌধুরী অভিনয় করেন।"৩০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক সংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে। প্রথম দিকে নাটক মঞ্চায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড।৩১
অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬
নাটক ও থিয়েটারের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে ভারতবর্ষের মানুষ যাতে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী কোন কার্যকলাপ না করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের হাতে। নীল, চা, তামাক ইত্যাদির পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক চাষাবাদও নিয়ন্ত্রণ করত ইউরোপীয়রা। বণিক ও নীলকরগণ অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণকে শোষণে লিপ্ত ছিল।
নীলকর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের শোষণ ও অবিচার অনেক নাট্যকর্মের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর বাংলায় প্রতিবাদী নাটকের ধারা প্রবর্তিত হয়। "১৮৬০ সালে ঢাকার বাংলা বাজারে রামচন্দ্র ভৌমিকের বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রে দীনবন্ধু মিত্রের যুগান্তকারী নাটক 'নীলদর্পণং নাটকং' প্রকাশিত হয়।"৩২, মধুসূদন দত্তের বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রো এবং একেই কি বলে সভ্যতা, কিরণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরোজিনী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরুবিক্রম, দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের চা-কর-দর্পণ, উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র বিনোদিনী ও অন্যান্য নাটক দেখতে প্রচুর লোক ভীড় জমাতেন। এসব নাটকে নীলকর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের শোষণ, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যগুলো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের উদ্রেক করত।
১৮৭৫ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতায় আগমন এবং একজন রাজভক্তের চাটুকারিতাকে ব্যঙ্গ করে রচিত ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসনে অভিনয় করার কারণে পুলিশ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার অমৃতলাল বসুকে গ্রেফতার করে। বাংলার সাধারণ মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ করে। এ ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৬ সালে ভারতে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন জারির কথা বিবেচনায় আনে।৩৩
বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল এসব নাটক মঞ্চায়নকে নাশকতামূলক কার্যকলাপ বলে ব্যাখ্যা করে সরকারের নিকট এ সুপারিশ পেশ করেন যে, যেহেতু বিদ্যমান আইনে এ ধরনের নাটকগুলো নিষিদ্ধ করার কোনো ক্ষমতা সরকারের নেই, সেহেতু কুৎসাপূর্ণ ও নাশকতামূলক নাটকাদি রচনা ও মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করে অবিলম্বে একটি আইন প্রণয়ন করা উচিত।
এরপর ১৮৭৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার বাংলা সরকারকে ব্রিটিশ বিরোধী নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশে বলা হয় যে, যখন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনে করবেন যে মঞ্চস্থ হয়েছে বা হতে যাচ্ছে এমন কোনো নাটক, পুতুলনাচ বা অন্য নাট্যকর্ম কুৎসাপূর্ণ বা নাশকতামূলক প্রকৃতির বা তা থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে বা সে ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের জন্য ক্ষতিকর, নৈতিকভাবে হানিকর হতে পারে বা অন্য কোনোভাবে জনস্বার্থের পক্ষে হানিকর হয়, তাহলে সরকার আদেশবলে সে ধরনের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করতে পারেন। অধ্যাদেশে আরও বলা হয় যে, ওই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে শুধু যে প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরাই আইনত শাস্তিযোগ্য হবেন তা নয়, দর্শক এবং থিয়েটার বা মঞ্চের মালিকরাও আইনত শাস্তির যোগ্য হবেন। অধ্যাদেশটি ১৮৭৬ সালের ১৪ মার্চ আইনে পরিণত হয়।৩৪
অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রতিবাদ করেন। তবে বেশ কিছু ব্রিটিশ সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এই আইনের প্রতিবাদে নিরব ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৫৪ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট, ১৯৫৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং ১৯৫৮ সালে পাঞ্জাব হাইকোর্ট এ আইনকে অকার্যকর ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওয়েস্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্স বিল নামে আইনের একটি নতুন খসড়া তৈরি করে। তবে গণপ্রতিবাদের মুখে সরকার ১৯৬৩ সালে বিলটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬ বাতিল করা হয়।৩৫
গণনাট্য আন্দোলন
১৯৩০ ও ১৯৪০এর দশকে বাংলার গ্রামীণ জনপদে সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটকের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে গণনাট্য আন্দোলন শুরু হয়। সংঘের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- বাঙালি নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য(১৭ জুলাই ১৯০৬ - ১৯ জানুয়ারি ১৯৭৮), বিশিষ্ট অভিনেতা এবং নাট্যকার উৎপল দত্ত(২৯ মার্চ ১৯২৯ - ১৯ আগস্ট ১৯৯৩) প্রমুখ।
মূল লক্ষ্য ছিলো তৃণমূলের গণমানুষকে নাট্যকলার মাধ্যমে সচেতন করে নিজেদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা। "গণনাট্য আন্দোলন বাংলার নাট্যসাহিত্যের উপর প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এখানকার জনমানসে সাংস্কৃতিক বিকাশও সাধন করেছে।"৩৬
গণসচেতনতার সর্বাঙ্গীন বিকাশ। মন্দিরা রায় লিখেছেন:
”গণনাট্য আন্দোলন' শব্দটি একটি বিশেষ সময়ের সন্ধিক্ষণের দলিল। মঞ্চ-পরিবেশের গতানুগতিকতা যখন বিস্তৃত হয়ে পড়েছিলো- সেই মুমূর্ষু নাট্যঅঙ্গনে একরাশ তাজা বাতাসের সুগন্ধ নিয়ে এসেছিলো এই আন্দোলন। 'গণনাট্যে'র অর্থ শুধু জনতা বা গণের নাটক নয়, সেই সঙ্গে একটি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক তথা নাট্যআন্দোলনও বটে।”৩৭
নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিজন ভট্টাচার্যের প্রতিভার সার্থকতম নিদর্শন হলো নবান্ন(১৯৪৪) নাটক। বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর পটভূমিকায় রচিত এই নাটকে দুঃস্থ-নিপীড়িত কৃষকজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় নবান্ন নাটকে তিনি নিজে অভিনয় করেন এবং অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র, গঙ্গাপদ বসু, শোভা সেন, গোপাল হালদার প্রমুখ। তার রচিত নাটকসমূহ ছিল গণনাট্য আন্দোলন পরিচালনার হাতিয়ার স্বরূপ। তার নাটকের অভিনয় যেমন গণনাট্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসেও এনে দিয়েছে নতুন নাট্যাঙ্গিকে বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রেরণা।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলা নাটকের ইতিহাসে দেশের
রাজনৈতিক পরিবর্তন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ
হয়েছে ঠিকই কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিচয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। মুখে বলছে আমরা বাঙালি কিন্তু
সীমান্তরেখায় একই পরিচয়ে ২টি দেশে এসে যায়। যদি পূর্বের ন্যায় একই পরিচয় বহাল থাকত
তাহলে বাংলার নাট্য ইতিহাস তথা সামগ্রিক ইতিহাস অনন্য উচ্চতায় থাকত। আবার ১৯০৫ সালে
বঙ্গভঙ্গ নাটক তথা সাহিত্য রচনার ধারাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বাংলা নাটকের যে একটা
উদ্দীপনা ছিল তা দেশভাগের পর কমে যায়। তবে বাংলা নাটকের ইতিহাস দেশের সীমান্ত পেরিয়ে
একটি দেশের সাথে অন্য একটি দেশের সম্পর্ক তৈরিতে সক্ষম। বাংলা নাট্য ও নাটক দুই বাংলার
চিরকালীন বাহন হোক।
তথ্যসূত্র
ও টীকা
১. সেলিম আল দীন, চাকা, মুখবন্ধ, ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০২।
২. বাংলা বিষয়ের ঐচ্ছিক পাঠক্রম, নেতাজিসুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পৃষ্ঠা: ৩৭৪।
৩. দর্শন চৌধুরী, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ১৯৯৫, পৃ: ১২।
৪. স্নাতকোত্তর পাঠক্রম, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা: PGBG - 6, পৃ: ১১।
৫. শাহিদা খাতুন, যাত্রা, বাংলাপিডিয়া, https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE
৬. ভারতবিদ্যা: ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্যের
কেতাবি বিদ্যা।
৭. দর্শন চৌধুরী, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ১৯৯৫, পৃ: ৬২, ৬৩
৮. প্রদ্যোত ঘোষ, বাংলা পিডিয়া।
৯. ড. প্রবীর প্রামাণিক, বিশেষ পত্র: নাটক ও নাট্যমঞ্চ, কল্যাণী
বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, পৃ: ১৪
১০. ব্যোমকেশ মুস্তাফি, বিশ্বকোষ।
১১. দর্শন চৌধুরী, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, কলকাতা: পুস্তক বিপণি,
১৯৯৫, পৃ: ৭৫
১২. কৌশিক সান্যাল, নবীন বসুর থিয়েটার, অনুষ্টুপ শারদীয়, ক্রোড়পত্র-২,
১৯৯৬, পৃ: ১-৫৫
১৩. ড. প্রবীর প্রামাণিক, বিশেষ পত্র: নাটক ও নাট্যমঞ্চ, কল্যাণী
বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, পৃ: ১৭
১৪. তদেব।
১৫. ড. প্রবীর প্রামাণিক, বিশেষ পত্র: নাটক ও নাট্যমঞ্চ, কল্যাণী
বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, পৃ: ২০
১৬. স্মরণ: অমৃতলাল বসু, শেয়ার বিজ। https://sharebiz.net/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%85%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%81/
১৭. মুন্সীগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। https://www.munshiganj.gov.bd/bn/site/page/hrsD-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF
১৮. ক্যাথরিন পিউরীফিকেশন, ঢাকার নবাব বাড়ির নাট্যচর্চা, থিয়েটার
স্টাডিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়, পৃ: ১২৫
১৯. মো. এনামুল হাসান কাওছার, দ্যা ডেইলি এডুকেশন।
https://www.tde24.com/2019/09/Baganbarir-Theatre.html
২০. জিল্লুর রহমান জন, নাট্যমঞ্চ, বাংলাপিডিয়া। https://bn.banglapedia.org/index.php/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A
২১. ওবায়দুল হক সরকার, পঞ্চাশ দশকের পত্র-পত্রিকায় " ঢাকার
নাটক", পৃ. ২৫
২২. জিল্লুর রহমান জন, নাট্যমঞ্চ, বাংলাপিডিয়া।
২৩. [জিল্লুর রহমান জন, বাংলাপিডিয়া।] https://bn.banglapedia.org/index.php/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A
২৪. গীতা সেনগুপ্ত, বিশ্বরঙ্গালয় ও নাটক, পৃ. ৬৫৫
২৫. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত "ঢাকা মহানগরীর নাট্যচর্চা", পৃ. ৫৫
২৬. ওবায়দুল হক সরকার, পঞ্চাশ দশকের পত্র-পত্রিকায় " ঢাকার নাটক", পৃ. ২৬
২৭. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত "ঢাকা মহানগরীর
নাট্যচর্চা", পৃ. ৫৬
২৮. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত "ঢাকা মহানগরীর নাট্যচর্চা", পৃ. ৫৮
২৯. তদেব।
৩০. ওবায়দুল হক সরকার, পঞ্চাশ দশকের পত্র-পত্রিকায় " ঢাকার নাটক", পৃ. ১৯
৩১. নাট্যবিদ্যা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ: ১৬৫
৩২. বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার ইতিবৃত্ত, মমতাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের নাট্যচর্চা, পৃষ্ঠা: ১৩৮
৩৩. স্মরণ: অমৃতলাল বসু, শেয়ার
বিজ। https://sharebiz.net/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%85%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%81/
৩৪. সিরাজুল ইসলাম, অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৭৬, বাংলা পিডিয়া।
৩৫. তদেব।
৩৬. ড. রুবেল আনছার, গণনাট্য আন্দোলন ও বিজন ভট্টাচার্য্যের নাটক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জার্নাল অব আর্টস, পৃ: ১০৯-১২৩
৩৭. মন্দিরা রায়, গণনাট্য এবং নবনাট্য: একটি বির্তক, কলকাতা: বামা
পুস্তকালয়, ২০০৪, পৃ. ৪
চিত্র ১: ওল্ড প্লে হাউস। https://asia.si.edu/explore-art-culture/collections/search/edanmdm:fsg_S1999.8.1/
চিত্র ২: চিত্র ১: সাঁ সুসি থিয়েটার। https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/under-british-rule-the-sans-souci-theatre-at-park-street-opened
চিত্র ৩: ওরিয়েন্টাল থিয়েটার। https://sah-archipedia.org/buildings/WI-01-MI155
চিত্র ৪: বেলগাছিয়া ভিলা। https://www.anandabazar.com/west-bengal/untold-story-of-dwarkanath-tagore-on-his-171th-death-anniversary-dgtl-1.650936
চিত্র ৫: সাধারণ রঙ্গালয় বা ন্যাশনাল থিয়েটার। https://archives.anandabazar.com/e_kolkata/2012/may/anache_kanache.html
চিত্র ৬: স্টার থিয়েটার।
https://lbb.in/kolkata/star-theatre-62b4a7/
চিত্র ৭: মিনার্ভা থিয়েটার। https://wikimapia.org/10660938/bn/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%BE-%E0%A6%A5%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0
কৃতজ্ঞতা-
মো. এনামুল হাসান কাওছার স্যার।
(খণ্ডকালীন শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,
ঢাকা। সহ-ব্যবস্থাপক - জনসংযোগ ও যোগাযোগ বিভাগ, সেমস-গ্লোবাল ইউএসএ।)
লেখক-
মুহাম্মদ আল ইমরান।
(শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।)
তারিখ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
Comments
Post a Comment