সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’ নাটক ফ্রেইট্যাগের পিরামিড কাঠামো ব্যবহার করে বিশ্লেষণ। মুহাম্মদ আল ইমরান
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ১ রচিত কালজয়ী নাটক ‘বহিপীর’২ ফ্রেইট্যাগের পিরামিড কাঠামো৩ ব্যবহার করে বিশ্লেষণ:
১. Exposition (উন্মোচন):
নাটকের শুরুতে
দর্শক বা
পাঠক চরিত্রগুলোর
সাথে পরিচিত
হয় এবং
কাহিনীর প্রেক্ষাপট
সম্পর্কে ধারণা
লাভ করেন
যা মূলত
উন্মোচন। যেখানে
চরিত্রে পরিচয়,
সামাজিক অবস্থান
সর্বোপরি কাহিনীর
উন্মোচন হয়।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর
এর বহিপীর
নাটকে দেখা
যায়, বহিপীর জমিদার হাতেম আলীর বজরায় আশ্রয় নেন। হাতেম আলী একজন
ধর্মপ্রাণ কিন্তু
দুর্বলচেতা জমিদার,
যিনি তাঁর
জমিদারি হারানোর
আশঙ্কায় ভীত।
তাঁর স্ত্রী
খোদেজা বেগম,
পুত্র হাসেম
আলী, তাহেরা,
হকিকুল্লাহ ও
কক্ষের বাইরে
যে চাকরটিকে
মসলা পিষতে
দেয়া যায়
তাদের উপস্থিতি
বহিপীরের ক্ষমতা
ও ভণ্ডামি,
হাতেম আলীর
অসহায়ত্ব এবং
জমিদার পরিবারের
সামাজিক অবস্থান
উন্মোচিত হয়।
তাহেরা অন্যায়
বিয়ে থেকে
বাঁচতে পালিয়ে
এসেছে এবং
তার আশ্রয়
হয়েছে হাতেম
আলীর বজরায়।
২. Inciting Incident (উদ্দীপ্তকারী
ঘটনা)
এই অংশে এমন
একটি ঘটনা
ঘটে যা
কাহিনীর মোড়
ঘুরিয়ে দেয়
এবং মূল
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত
ঘটায়। বহিপীরের
হাতেম আলীর
নিকট আশ্রয়
গ্রহণ এবং
তাহেরার সন্দেহ
তৈরি যে
এই পীরই
সেই বহিপীর।
তাহেরার জনালার
কাছে গিয়ে
পানি দেখা
ও ঝাঁপ
দেয়ার কথা
বলা এই
নাটকের উদ্দীপ্তকারী
ঘটনা।
৩. Rising Action (উর্দ্ধোমুখি ক্রিয়া)
উদ্দীপ্তকারী ঘটনার
পর থেকে
চূড়ান্ত সংঘাতের
আগ পর্যন্ত
কাহিনীর উত্তেজনা
ক্রমশ বৃদ্ধি
পেতে থাকে।
এই পর্যায়ে
বেশ কিছু
ঘটনা ও
চরিত্রগত দ্বন্দ্ব
দেখা যায়।
তাহেরার দৃঢ়তা
যে তাহেরা
বারবার তার
অবস্থানে অটল
থাকে এবং
বহিপীরের সাথে
যেতে অস্বীকার
করে। সে
তার মুক্তির
জন্য আকুতি
জানায়।
বহিপীরের কূটচালের
মধ্য দিয়ে
বিভিন্ন কৌশল
অবলম্বন করে
তাহেরাকে বশে
আনার চেষ্টা
করেন। তিনি
ধর্মীয় প্রভাব,
ভয়ভীতি এবং
নৈতিকতার প্রশ্ন
তুলে হাতেম
আলীকে প্রভাবিত
করার চেষ্টা
করেন।
হাতেম আলীর
ছেলে হাশেম
তাহেরার পক্ষে
দাঁড়ায় এবং
বহিপীরের ভণ্ডামির
বিরুদ্ধে সোচ্চার
হয়। সে
বহিপীরের ক্ষমতাকে
চ্যালেঞ্জ করে
এবং তাহেরাকে
মুক্তির পথ
দেখায়।
হাতেম আলী
ধর্মীয় বিশ্বাস
ও সামাজিক
চাপের মধ্যে
আটকা পড়ে
যান। তিনি
একদিকে বহিপীরের
ক্ষমতাকে ভয়
পান, অন্যদিকে
তাহেরার প্রতি
তার সহানুভূতি
জন্মায়। এই
অন্তর্দ্বন্দ্ব তাকে
সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগায়।
হাতেম আলীর
ওপর বহিপীরের
আর্থিক চাপ
প্রয়োগ, অর্থাৎ
জমিদারির খাজনা
পরিশোধের জন্য
টাকা ধার
দেওয়ার বিনিময়ে
তাহেরাকে ফেরত
চাওয়া, কাহিনীর
উত্তেজনা আরও
বাড়িয়ে তোলে।
এটি হাতেম
আলীকে আরও
বিপাকে ফেলে
দেয়।
৪. Climax (চূড়ান্ত জটিল
অবস্থা)
এটি নাটকের সেই
মুহূর্ত যেখানে
সংঘাত চরমে
পৌঁছায় এবং
চরিত্রদের ভবিষ্যৎ
নির্ধারিত হয়।
বহিপীর যখন
হাতেম আলীর
জমিদারি বাঁচানোর
জন্য টাকা
ধার দেওয়ার
প্রস্তাব দেন
এবং বিনিময়ে
তাহেরাকে দাবি
করেন, তখনই
চূড়ান্ত জটিলতা
তৈরি হয়।
হাতেম আলী
এক কঠিন
সিদ্ধান্তের মুখোমুখি
হন – তার
জমিদারি রক্ষা
করবেন নাকি
তাহেরাকে তার
ভাগ্যের হাতে
ছেড়ে দেবেন।
এই মুহূর্তে
হাসেম আলী
তাহেরাকে নিয়ে
পালানোর সিদ্ধান্ত
নেয় এবং
তারা একসাথে
নৌকাযোগে পালিয়ে
যায়। এটি
বহিপীর এবং
সমাজের বিদ্যমান
মূল্যবোধের প্রতি
তাহেরা ও
হাসেমের সম্মিলিত
বিদ্রোহের চূড়ান্ত
প্রকাশ। এই
মুহূর্তেই বহিপীরের
ভণ্ডামি ও
ক্ষমতার অপব্যবহারের
বিরুদ্ধে একটি
নৈতিক জয়
সূচিত হয়।
৫. Falling Action (নিম্নমুখী
ক্রিয়া)
চূড়ান্ত জটিল
অবস্থার পর
কাহিনীর উত্তেজনা
ধীরে ধীরে
কমতে থাকে
এবং সংঘাতের
পরিণতি প্রকাশ
পেতে শুরু
করে। হাসেম
ও তাহেরার
পলায়নের পর
বহিপীর তাদের
ধরতে ব্যর্থ
হন। তার
ক্ষমতা ও
প্রভাবের ব্যর্থতা
প্রকাশিত হয়।
তিনি বুঝতে
পারেন যে
তার ভণ্ডামি
সবার কাছে
উন্মোচিত হয়েছে
এবং তার
আধিপত্য হুমকির
মুখে পড়েছে।
জমিদারি হারানোর
ভয় সত্ত্বেও
হাতেম আলী
এক ধরনের
স্বস্তি অনুভব
করেন। তাহেরা
পালিয়ে যাওয়ায়
তিনি নৈতিকভাবে
মুক্ত হন,
কারণ তাকে
অন্যায় সিদ্ধান্ত
নিতে হয়নি।
তিনি বহিপীরের
প্রভাব থেকে
কিছুটা হলেও
মুক্তি পান।
অন্যান্য চরিত্র(যেমন খোদেজা বেগম)
নিজ ভূমিকা
থেকে সরে
আসেন। কাহিনীর
পরবর্তী পদক্ষেপ
স্পষ্ট হয়ে
যায়।
৬. Resolution (সমাধান):
এই অংশে কাহিনীর
সমস্ত দ্বন্দ্বের
সমাধান হয়
এবং একটি
নতুন স্থিতাবস্থা তৈরি হয়।
বহিপীরের উদ্দেশ্য
ব্যর্থ হয়।
তবুও তিনি
বলেন, “আসুন জমিদার
সাহেব,
আমার
আপনার
জমিদারি
রক্ষার
ব্যবস্থা
করি।”
শেষ সংলাপে
বহিপীরের এমন
বার্তা নাটকের
সমাধানের মিলনাত্বক
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
দেয়। হাসেম
আলী এবং
তাহেরা একটি
নতুন জীবনের
সন্ধানে অনিশ্চিত
ভবিষ্যতের দিকে
যাত্রা করে।
তাদের পালিয়ে
যাওয়া একদিকে
যেমন প্রচলিত
সমাজের অন্যায়
ও অমানবিকতার
বিরুদ্ধে একটি
প্রতিবাদ, তেমনি
অন্যদিকে নতুন
দিগন্তে মুক্তির
প্রতীক। যা
স্বাধীন ইচ্ছা
শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
আপাতদৃষ্টিতে যদিও
তাদের ভবিষ্যৎ
অস্পষ্ট, তবুও
তারা একটি
বন্ধনমুক্ত জীবনের
দিকে এগিয়ে
যায়। বহিপীর
নাটকটি একটি
ইতিবাচক বার্তা
দেয় – অন্যায়ের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
এবং স্বাধীন
ইচ্ছা শক্তির
জয়। প্রচলিত
সমাজের কুসংস্কার
ও ধর্মীয়
ভণ্ডামির বিরুদ্ধে
এক সাহসী
বিদ্রোহের মধ্য
দিয়েই নাটকের
পরিসমাপ্তি ঘটে।
·
তথ্যসূত্র
১. নাট্যকার
হিসেবে সৈয়দ
ওয়ালীউল্লাহ:
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
প্রধানত ঔপন্যাসিক
ও ছোটগল্পকার
হিসেবে পরিচিত
হলেও, নাট্যকার
হিসেবেও তার
অবদান অনস্বীকার্য।
তার নাটকগুলো
তৎকালীন সমাজের
কুসংস্কার, ধর্মীয়
গোঁড়ামি এবং
মানবিক সংকটের
গভীর বিশ্লেষণ
করে। তার
লেখা নাটকগুলো
হলো:
-
বহিপীর (১৯৬০):
এটি তার
সবচেয়ে বিখ্যাত
নাটক। এই
নাটকে তিনি
ধর্মীয় ভণ্ডামি,
নারী স্বাধীনতা
এবং সামাজিক
প্রথা ভাঙার
আকাঙ্ক্ষাকে তুলে
ধরেছেন। ১৯৫৫
সালে এটি
পিইএন ক্লাবের
উদ্যোগে আয়োজিত
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে
পুরস্কার লাভ
করে।
-
উজানে মৃত্যু
(১৯৬৩): এই
নাটকটি ওয়ালীউল্লাহর
নাট্যচিন্তার আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক
তুলে ধরে।
-
সুড়ঙ্গ (১৯৬৪):
এটি মূলত
শিশু-কিশোরদের
জন্য রচিত
নাটক।
-
তরঙ্গভঙ্গ (১৯৭১):
এটি তার
আরেকটি উল্লেখযোগ্য
নাটক, যেখানে
তিনি অস্তিত্ববাদী
ধারণা ও
মানুষের মানসিক
টানাপোড়েনকে ফুটিয়ে
তুলেছেন।
ওয়ালীউল্লাহর নাটকগুলো
সে সময়ের
প্রচলিত ঐতিহাসিক
বা পৌরাণিক
নাটকের ধারা
থেকে বেরিয়ে
এসে সমসাময়িক
সামাজিক ও
মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে
প্রাধান্য দিয়েছে।
তিনি তার
নাটকে আধুনিক
শিল্পচেতনা এবং
নিরীক্ষাধর্মিতা নিয়ে
এসেছিলেন, যা
বাংলা নাট্যসাহিত্যে
এক নতুন
দিগন্ত উন্মোচন
করে।
২. সৈয়দ
ওয়ালীউল্লাহর 'বহিপীর'
নাটকটি অস্তিত্ববাদী
দর্শনের আলোকে
মানুষের অস্তিত্বের
সংকট, স্বাধীনতা,
নির্বাচন এবং
দায়বদ্ধতার মতো
বিষয়গুলো তুলে
ধরে। এই
নাটকের প্রধান
চরিত্র তাহেরা
সমাজের প্রচলিত
নিয়ম ও
ধর্মীয় ভণ্ডামির
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
করে নিজের
স্বাধীনতা ও
স্বকীয় অস্তিত্ব
প্রতিষ্ঠা করতে
চায়।
৩. জার্মান
ঔপন্যাসিক ও
নাট্যকার গুস্তাভ
ফ্রেইটাগ তার
"ডাই টেকনিক
দেস ড্রামাস"
(Die Technik des Dramas) নামক গ্রন্থে
(১৮৬৩ সালে
প্রকাশিত) এই
পাঁচ বা
ছয়টি অংশের
সমন্বয়ে গঠিত
নাটকের কাঠামোটি
ব্যাখ্যা করেন।
এটি ফ্রেইটাগের
পিরামিড (Freytag's Pyramid) নামে পরিচিত।
- মুহাম্মদ আল ইমরান
নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
Comments
Post a Comment