“মহানবী (সা.) এর বৈদেশিক ও কূটনৈতিক কৌশল: বর্তমান বিশ্বে এর প্রায়োগিক বিশ্লেষণ।” - মুহাম্মদ আল ইমরান
“মহানবী (সা.) এর বৈদেশিক ও কূটনৈতিক কৌশল:
বর্তমান বিশ্বে এর প্রায়োগিক বিশ্লেষণ।”
মুহাম্মদ আল ইমরান
মহানবী (সা.) এর বৈদেশিক ও
কূটনৈতিক কৌশল একটি সুদূরপ্রসারী এবং নৈতিক ভিত্তি সম্পন্ন ব্যবস্থা, যা মানবজাতির
কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। কুরআন, সুন্নাহ এবং মহানবী (সা.) ও খুলাফায়ে রাশিদীনের
জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলি বর্তমান জটিল বিশ্বে একটি দিশা দেখাতে পারে। মুসলিম
দেশগুলো যদি এই নীতিগুলি আন্তরিকভাবে অনুসরণ করে, তাহলে তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়,
বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি স্থিতিশীল, ন্যায়সংগত এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে
পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বের নিজেদের মধ্যেকার বিভাজন দূর করা এবং ইসলামের
নৈতিক মূল্যবোধকে তাদের কার্যক্রমে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
সৃষ্টিকর্তার এই সুন্দর পৃথিবীর
অতীব লক্ষণীয় বিষয় হলো কেউ কারো মত না। প্রতিটি মানুষ পৃথক। পৃথিবী প্রাণীর প্রাণজ্জ্বলতায়
প্রাণবন্ত। তবে এহেন প্রাণীর বিবেচনায় মানব সেরা। মানুষ কত কি করে! সুন্দরভাবে বেঁচে
থাকতে চায়। বাঁচার জন্য কত নিয়ম তৈরি করে নেয়। চোখ বন্ধ করে যদি বর্তমান বিশ্বের কথা
বিবেচনা করি তাহলে কি দেখতে পাই? বেঁচে থাকার জন্য জীবনময় যুদ্ধ! কেউ কারো কাছে শির
নত করতে প্রস্তুত নয়। অথচ মানবের মূল মাধুর্য হওয়া উচিত ছিল মানবিকতা। সীমান্তরেখার
চিহ্ন দিয়ে হয়ত একটি দেশের মানুষের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষের ভৌগোলিক দূরত্ব নির্দেশ
করে। কিন্তু কার্যত মানুষ দৈনিক চিন্তা চেতনায় এক হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষের এক হওয়া প্রবণতা
বিভিন্ন কারণে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এমন অবস্থান থেকে উত্তরণের সহজ পথ। আর সেই পথ
হলো মানবের মানবিকতা। হযরত মুহম্মদ (সা.) তার জীবনে যে সকল পন্থা অবলম্বন করে তার চলার
পথ তৈরি করেছেন সেই পথ হতে পারে আমাদের বর্তমান বিশ্বের আদর্শ।
সাধারণত, বৈদেশিক নীতি বলতে
কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় নীতির সেই অংশকে বোঝানো হয়, যা বহির্বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্ক
নির্ধারণ করে। বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্রই বিশ্ব সমাজের অবিচ্ছেদ্য সদস্য। নিজের নানামুখী
প্রয়োজন মেটাতে এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিটি দেশই অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক
স্থাপন ও বজায় রাখতে বাধ্য হয়।
ব্যাপক অর্থে, বৈদেশিক নীতি
হলো একটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যাবতীয় দিক, যা তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং
সামরিক স্বার্থ রক্ষা করে। যা কেবল অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন
সংস্থা ও জোটের সঙ্গেও তার আচরণ ও অবস্থানকে অন্তর্ভুক্ত করে। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রতিটি
দেশ কীভাবে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের ভূমিকা পালন করবে, তারই পথনির্দেশ করে এই বৈদেশিক নীতি।
ইসলাম আগমনের আগে আরবসহ পুরো
বিশ্বে অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং অন্ধকার বিরাজ করছিল। মেয়েরা জীবিত অবস্থায় কবরস্থ
হতো, সমাজে দুর্বলরা ছিল অত্যাচারিত, এবং গোত্রে গোত্রে হানাহানি ছিল যেন নিত্যনৈমিত্তিক
ব্যাপার। মহান আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন মূলত
মানবজাতিকে পথপ্রদর্শন করার জন্য এবং তাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য। পবিত্র
কুরআনে সুরা আত-তাওবার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
هُوَ الَّذِىۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰى وَدِيۡنِ الۡحَـقِّ لِيُظۡهِرَهٗ عَلَى الدِّيۡنِ كُلِّهٖۙ وَلَوۡ كَرِهَ الۡمُشۡرِكُوۡنَ ٣٣
“তিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত আর সঠিক দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যাবতীয় দ্বীনের
উপর একে বিজয়ী করার জন্য যদিও মুশরিকগণ অপছন্দ করে।”১
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা
আরো বলেন,
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰكَ اِلَّا رَحۡمَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۰۷﴾
“আমি আপনাকে জগৎসমূহের জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।”২
ইসলামের ইতিহাসে মুহম্মদ
(সা.)-এর শাসনব্যবস্থা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। যে সমাজ ছিল গোত্রীয় হানাহানি
ও বিশৃঙ্খলায় ভরপুর, তার দূরদর্শী নেতৃত্ব সেই সমাজকে এক সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতিতে
রূপান্তরিত করে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক শাসন ছিল না, বরং শান্তি, নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচারের
এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই শাসনব্যবস্থা ছিল এমন এক আদর্শ,
যা মানবতাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে এবং একটি অসভ্য সমাজকে ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল
ও সভ্য জাতিতে রূপান্তরিত করে।
মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর
রাষ্ট্র পরিচালনা ছিল ইনসাফ, সাম্য, সহাবস্থান এবং নৈতিকতার এক অসাধারণ মডেল। এটি শুধু
একটি রাষ্ট্র গঠনই নয়, বরং একটি সভ্য, সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ
দেখিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি হয়ে ওঠে। “সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বিভিন্ন বিভাগ খুলে দিয়ে বিভিন্ন জনকে তা
পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।”৩ তবে প্রতিনিধি ও কর্মচারী নিয়োগ, মুয়াযযিন নির্বাচন,
ইমাম নির্ধারণ, যাকাত আদায়কারী নিয়োগ, জিজিয়া আদায়কারী নিয়োগ, ভিন্ন ধর্মের সাথে সন্ধিপত্র
স্বাক্ষর করা, মুসলমানদের মধ্যে জমি বণ্টন করা, সেনাপতি নিয়োগ, মামলা মোকদ্দমা ফয়সালা
করা, গোত্রে গোত্রে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা, বেতন নির্ধারণ করা, অপরাধীর শাস্তি বিধান জারি
করা, নও মুসলিমদের ব্যবস্থাপনা, ফতোয়া দান, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান, কর্মচারীদের পরিসংখ্যান
ও উন্নয়ন বিধান করা, গভর্নর ও ওয়ালী নিয়োগ করা ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব স্বীয় রাসুলুল্লাহ
(সা.) দেখতেন। তিনি নিজে যেমন দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন তেমনি অন্য সবার মাঝে তাদের
দায়িত্ব বণ্টন করেছেন। ফলে এক সুন্দর রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃঢ় অবস্থান তৈরি হয়েছে।
পাশ্চাত্য মনীষী স্মিথ বলেছেন,
“পৃথিবীতে যদি কেউ অমুসলিমদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার গৌরব দাবি করতে
পারে, তবে তিনি একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (স) ছাড়া আর কেউ নন।” ৪
মহানবী (সা) অমুসলিম নাগরিকদের
জানমাল, মান-সম্মান এবং নিজস্ব ধর্মাচার পালনের পূর্ণ অধিকার ও নিরাপত্তা বিধান করেন।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের জন্য রাষ্ট্রীয় মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেন। বিভিন্ন
ধর্মাবলম্বী লোকদের নিয়ে এক সাথে শান্তিতে বসবাস করার প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের এক অনন্য
দৃষ্টান্ত। আবার মহানবী (সা.) মদিনা রাষ্ট্রের সঙ্গে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের
সঙ্গে যে-রূপ সম্পর্ক রেখেছিলেন এবং পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
স্থাপনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন—তা অত্যন্ত দূরদর্শী, মানবিক ও সার্বজনীন।
মহানবী (সা.)-এর কূটনৈতিক
সাফল্যের অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো মদিনা সনদ। “মদিনায় বসবাসরত সব গোত্রের মধ্যে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৪৭ মতান্তরে
৫৩ ধারার একটি সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে পরিচিত।”৫
এটি ছিল একটি লিখিত চুক্তি, যা মদিনার মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য গোত্রের মধ্যে সম্পাদিত
হয়। এই সনদের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি বহু-ধর্মীয় ও বহু-জাতিগত সমাজের মধ্যে শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থান নিশ্চিত করা। মদিনার অমুসলিম সম্প্রদায়গুলো তাদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি
পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করত। এই ব্যবস্থা প্রমাণ করে যে, একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন
ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে, যেখানে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের
ওপর কোনো ধরনের আধিপত্য বিস্তার করবে না। মহানবী (সা.)-এর এই বিপ্লবী পদক্ষেপগুলো শুধু
তৎকালীন সমাজেই পরিবর্তন আনেনি, বরং বর্তমান বিশ্বের জন্য শান্তির, সহনশীলতার এবং মানবজাতির
ঐক্যের এক অনবদ্য বার্তা বহন করে চলেছে। তার প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্র ছিল আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার
এক উজ্জ্বল মাইলফলক, যা আজও মানবতাকে পথ দেখায়।
হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছে
মহানবী (সা.) উছমান (রা.) কে এই খবর দেয়ার জন্য মক্কায় পাঠালেন যে, আমরা যুদ্ধ করার
জন্য মক্কায় আসছিনা। উমরাহ পালন করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধির
ব্যাপারে আলোচনা শুরু হল। আলোচনা সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। এক পর্যায়ে মহানবী (সা.) এর
কাছে খবর পৌঁছল যে, কুরাইশরা উছমান (রা.) কে হত্যা করে ফেলেছে। মুসলমানেরা এই খবর শুনে
প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। কিন্তু উছমান (রা.) এর আগমনে পরিস্থিতি
শান্ত হল। পুনরায় নতুন করে সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা শুরু হল। আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে
নিম্নে বর্ণিত শর্তে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি রচিত হল। ইসলামের ইতিহাসে
এটি হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। অর্থাৎ যে কোনো সমস্যার সহজ সমাধান আলোচনা-পর্যালোচনা।
যা বিশ্বকে এক নতুন উদ্দীপনা দিবে।
হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে দাওয়াতের
পথ মসৃণ হয়। ফলে বিশ্বনেতাদের কাছে চিঠি লেখেন। গবেষকদের মতে, মহানবীর (সা.) চিঠি পাঠানোর
এই পদক্ষেপ ইসলামের দাওয়াতের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক সাহসী
কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ ও মিসরের
সম্রাট মুকাওকিস প্রমুখ উল্লিখিত চিঠি প্রাপকদের নিকট মহানবী (সা.) এর চিঠি প্রেরণের
ফলে ইসলামের মূল শিক্ষা ও শান্তির বার্তা তুলে ধরা হতো। যাতে তারা অনেকে ইসলাম গ্রহণ
করেন। ইসলাম প্রচার করা ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করার জন্য বিভিন্ন দেশের
শাসকদের কাছে তার সাহাবিদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের শাসকদের সঙ্গে
সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করতেন যে মুসলমানদের ওপর বহিরাগত আক্রমণ আসবে
না।
এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে
হবে যে, বর্তমান বিশ্বের- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে সবচেয়ে
বড় লাভ হত অর্থনীতিতে। দুই দেশের মধ্যে সহজে বাণিজ্য করা যায়, যা আমদানি ও রপ্তানিকে
সহজ করে তোলে। এতে পণ্যের খরচ কমে এবং উভয় দেশের বাজার প্রসারিত হয়। এছাড়াও, যৌথভাবে
বড় বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নেওয়া সম্ভব হয়, যেমন—সড়ক ও রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন,
বা আঞ্চলিক বাণিজ্য করিডোর তৈরি। এতে খরচ ভাগ হয়ে যায় এবং দ্রুত কাজ শেষ করা সম্ভব
হয়। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এমন পরিবেশে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হন যেখানে
তাদের আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকে, কারণ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ঝুঁকি কমে
যায়। যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের এক ধাপ। আবার সীমান্ত সংক্রান্ত উত্তেজনা ও সংঘাত
অনেক কমে আসে। আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায়, যা সামরিক
ব্যয় কমিয়ে দেয় এবং দেশের নিরাপত্তা জোরদার করে। সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালান এবং অন্যান্য
অপরাধ দমনের জন্য তথ্য আদান-প্রদান করাও সহজ হয়। আন্তর্জাতিক ফোরামে কোনো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় আসলে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো একে অপরের প্রতি সমর্থন দিতে পারে, যা উভয় দেশের কূটনৈতিক
অবস্থানকে শক্তিশালী করে তোলে। একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ভালো সম্পর্ক শুধু একটি
দেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের শান্তি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এটি
সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি নতুন নতুন সুযোগের দুয়ার খুলে দেয়।
মহানবী (সা.) মদিনায় খ্রিষ্টান,
ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর
এই আদর্শ বর্তমান যুগে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এমনকি
“যখন কোন মৃতদেহ, তা খ্রিষ্টান বা ইহুদি যে
কারও হোক না কেন, সামনে দিয়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে বলেছেন মহানবী (সা.)”৬
আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক হলো বিভিন্ন
ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সহযোগিতা। এটি কেবল ধর্মতত্ত্বের
একটি বিষয় নয়, বরং আধুনিক সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী।
যখন বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একে অপরের বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে সম্মান করে, তখন সমাজে বিভেদ
ও সহিংসতা কমে আসে। আন্তঃধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে ভুল ধারণা দূর করা যায় এবং একই সঙ্গে
মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী বিশ্ব মানচিত্রের ভিত্তি তৈরি যায়।
আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক উন্নত
করার জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ধর্মের নেতাদের মধ্যে নিয়মিত
আলোচনা ও সংলাপের আয়োজন করা প্রয়োজন, যাতে তারা নিজ নিজ ধর্মের মূল বার্তাগুলো তুলে
ধরতে পারেন এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে পারেন। এছাড়াও, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা
একসঙ্গে বিভিন্ন যৌথ কর্মকাণ্ড হিসেবে সামাজিক ও মানবিক কাজ করতে পারেন। যেমন—একসঙ্গে
গরিবদের সাহায্য করা, দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা বা পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করা। এসব
যৌথ কর্মকাণ্ড মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বন্ধুত্ব তৈরি করে।
সমাজে উগ্রবাদ ও বিভেদ দূর
করে একতা ও সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে, যা একটি স্থিতিশীল এবং উন্নত সমাজের জন্য অপরিহার্য।
আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের মূল লক্ষ্য হলো ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও মানুষকে মানুষ
হিসেবে সম্মান করা এবং একসঙ্গে একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করা।
মহানবী (সা.) এর নিকট অন্যান্য
দেশ থেকে আসা দূত ও প্রতিনিধিদের প্রতি সর্বদা আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যদি কোন
প্রতিনিধি বা দূত ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করত, তাহলে তাদের সঙ্গেও মহানবী (সা.)
কোনো ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন না। অন্য দেশের দূতদের প্রতি আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল
আচরণ করার মূল কারণ হলো এটি একটি দেশের ভাবমূর্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের
জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আচরণ শুধু কোনো দেশের আতিথেয়তা নয়, বরং এটি একটি সুদূরপ্রসারী
কূটনৈতিক কৌশল।
আগত দূত ও প্রতিনিধিদের প্রতি
সর্বদা আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল থাকলে- প্রথমত, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিধা বয়ে নিয়ে
আসে, দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন
বিষয়ে সমর্থন পাওয়া সহজ হয়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোনো
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমাদের দেশের কোনো প্রস্তাব সমর্থন করাতে হবে, তখন সেই দেশের
দূতের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক থাকলে সেই সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
এছাড়া, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান সহজ হয়, যা সন্ত্রাসবাদ বা অন্য কোনো
নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক এবং
বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক। আগত প্রতিনিধিরা তাদের দেশের অর্থনৈতিক আগ্রহের প্রতিনিধিত্ব
করেন। তাদের প্রতি আন্তরিক ব্যবহার করলে তারা তাদের নিজ দেশে আমাদের দেশের সুনাম এবং
সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরতে পারেন। এর ফলে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। ভালো
সম্পর্ক থাকলে বাণিজ্যিক চুক্তি ও আলোচনা সহজ হয়, যা রপ্তানি ও আমদানি বাড়াতে সাহায্য
করে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও মজবুত হয়।
তৃতীয়ত, আন্তরিক আচরণ একটি
দেশকে বিশ্বে সভ্য ও উন্নত জাতি হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। এটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথ
খুলে দেয়, যার ফলে উভয় দেশের মানুষ একে অপরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনধারা সম্পর্কে
জানতে পারে। এই ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে আরও বেশি শ্রদ্ধা
ও সহযোগিতা তৈরি করে। মূলত অন্য দেশের দূতদের প্রতি আন্তরিক আচরণ করা একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি
সাফল্য ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু সৌজন্যতা নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের
জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ।
আজকের পৃথিবীতে যখন সংঘাত,
অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন মহানবী (সা.)-এর বৈদেশিক ও কূটনৈতিক কৌশল আরও
বেশি প্রাসঙ্গিক। জাতিগত বিভাজন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং রাজনৈতিক অবিশ্বাসের এই সময়ে
তার আদর্শগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে
আমাদের পথ দেখাতে পারে। তার শিক্ষা কেবল ধর্মীয় অনুসারীদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির
জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। মহানবী (সা.)-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি ছিল মানবতা,
ন্যায়, সমতা ও শান্তি। বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতির ক্ষেত্রে তার এসব শিক্ষা
একটি আদর্শ হিসেবে প্রয়োগযোগ্য। তার জীবনের এই অংশ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলামী
দর্শনের মূল ভিত্তি শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং মানবিকতার প্রতিও দায়িত্বশীলতা।
এই মহান আদর্শকে আরও বিস্তৃত
করে বলা যায় যে, আধুনিক বিশ্বের জন্য মহানবী (সা.)-এর কূটনীতি একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল
হিসেবে কাজ করতে পারে। তার দেখানো পথ ধরে যেকোনো জাতি ও রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক
সম্মান, বোঝাপড়া এবং সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারে। ‘মহানবী (সা.) এর বৈদেশিক ও কূটনৈতিক
কৌশল’ আমাদের চিন্তাজগৎ অধিকার করে বিকশিত হোক!
• তথ্যসূত্র
১. সুরা আত-তাওবা, ৯:৩৩
২. সূরা আম্বিয়া, ২১:১০৭
৩. কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে
রাসূল (সা.) এর ২৪ ঘণ্টা, পিস পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১২
৪. মনীষী স্মিথ এর উক্তি।
৫. মহানবীর বড় ৫ কূটনৈতিক
সাফল্য, মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ, আজকের পত্রিকা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
https://www.ajkerpatrika.com/islam/ajplps7wjxlk7
৬. মহানবীর (সা.) শ্রেষ্ঠ
বাণী, মাহমুদ ইকবাল, সূচিপত্র, ঢাকা, ২০২১
Comments
Post a Comment